নারীর ক্ষমতায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
মোঃ সাখাওয়াত হোসেনঃ
ক্ষমতায়ন প্রত্যয়টি সমসাময়িক তাৎপর্যে সর্বক্ষেত্রে উচ্চারিত হয়ে আসছে বিশেষ গুরুত্বসহকারে। সরকারও ক্ষমতায়নের বাতায়ন নিয়ে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। প্রেক্ষিত এবং বাস্তবতা বিবেচনায় ক্ষমতায়ন বিষয়টি খুবই মহিমান্বিত এবং যথাযথ হবে যদি তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু ক্ষমতায়ন প্রত্যয়টি এতটাই সুবিশাল এবং এর পরিধির পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে প্রয়োগে যে কোন রাষ্ট্রকে তথা রাষ্ট্রপ্রধানকে হিমশিম খেতে হয়। আর যদি রাষ্ট্রটি হয় উন্নয়নশীল তবে চাহিদা এবং যোগানের ভারসাম্যহীন প্রতিযোগিতায় সে রাষ্ট্রে ক্ষমতায়ন প্রত্যয়ের প্রয়োগ কষ্টসাধ্য এবং চ্যালেঞ্জস্বরূপ হয়ে পড়ে। অনেক উন্নত রাষ্ট্রেই আমরা ক্ষমতায়নের মূলনীতির বাস্তবায়ন কার্যত দেখতে পায় না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ক্ষমতায়নের বৈশিষ্ট্যে অনন্য, বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বীকৃত পেয়েছে বাংলাদেশ। আলোচিত নিবন্ধে জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নারীর ক্ষমতায়নের স্বার্থে গৃহীত পদক্ষেপ, বাস্তবায়নের হার এবং তৎভিত্তিতে ফলাফলের স্বরূপ বিশ্লেষণ করাই মূল লক্ষ্য।
ক্ষমতায়ন বলতে বোঝায়, পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থায় প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ জীবনমান অর্জন, যার ভিত্তিতে ব্যক্তি (নারী ও পুরুষ) তার একক স্বাধীনতায় নিজের জীবনে কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজ যোগ্যতায় জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। সাধারণের মতে, ক্ষমতায়ন বলতে নারীর শিক্ষাব্যবস্থা বা একটি চাকরির যোগান দেয়াকে বোঝানো হয়। কিন্তু আক্ষরিক অর্থে ক্ষমতায়ন ব্যক্তিকে তার নিজের কাজ সম্পর্কে স্বাবলম্বী করে তোলে, আত্মবিশ্বাসী, আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার কৌশল শেখায় যার উপর দাঁড়িয়ে ব্যক্তি যে কোন সমস্যার মোকাবেলা করতে পারেন দৃঢ়ভাবে। সুতরাং, ক্ষমতায়ন হলো সে বিশেষ ক্ষমতা বা অদৃষ্ট শক্তি যার মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের ভেতরে অপ্রকাশিত থাকা প্রতিভাকে প্রস্ফুটিত করতে পারেন আপন মহিমায়, মহিমান্বিত করে তোলে নিজের জীবনকে নিজস্ব চিন্তাচেতনা আর কৃতকর্মের মাধ্যমে।
ক্ষমতায়ন একটি প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়াটি কার্যকরের জন্য কয়েকটি ধাপ সুসম্পন্ন করতে হবে বিশেষভাবে। প্রথমত ব্যক্তিগত ধাপ, যে ধাপে ব্যক্তির নিজস্ব ধ্যান-ধারণা, যোগ্যতা, সামর্থ্য ও আত্মবিশ্বাসের স্ফুরণ ঘটে। দ্বিতীয় ধাপ সম্পর্ক, এর মাধ্যমে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের অন্য ব্যক্তির সম্পর্কের সামঞ্জস্যতা বোঝায় এবং নিজ থেকে অন্যের উপর কতটা প্রভাব ফেলতে তার পরিমাণকে বোঝানো হয়। তৃতীয়টি, সামষ্টিক সক্ষমতা, সমাজের সকলের সঙ্গে কাজ করার যোগ্যতাকে বোঝানো হয়। ভিন্নগ্রুপের সঙ্গে ভিন্ন মেজাজে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে সব কাজে সক্রিয় থাকার প্রচেষ্টা।
আমাদের দেশে যখন ক্ষমতায়নের বিষয়টিকে ইস্যু হিসেবে নেয়া হয়, তখন নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টিকে বোঝানো হয়। প্রকৃতপক্ষে, পুরুষরা যে ক্ষমতায়নের বাইরে রয়ে যায় অনেক ক্ষেত্রেই, সে বিষয়টি পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় আলোচনায় নিয়ে আসতে চায় না অনেকেই। যাই হোক, আমাদের বিষয় যেহেতু নারীর ক্ষমতায়ন সেহেতু এ বিষয়ের উপর আলোচনায় থাকাই প্রাসঙ্গিক। নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে উল্লেখ করা যায়। প্রথমত. অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন যার মাধ্যমে নারীর অর্থনীতির মূল ধারায় পূর্ণ অংশগ্রহণকে বোঝায়। এতে যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য কাজ করা, যে কোন ভাল কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ, পরিবারকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা, রাষ্ট্রীয় যে কোন কাজে পুরুষের ন্যায় সমান সুযোগ লাভের অধিকার ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত. সামাজিক ক্ষমতায়ন বলতে নারীর ব্যক্তিগত অধিকারকে বোঝানো হয়, গ্রামে-গঞ্জে এখনও সালিশে নারীদের মতামতের কোন গুরুত্ব প্রদান করা হয় না। এ অবস্থা থেকে দ্রুতই বেরিয়ে আসতে হবে নিরপেক্ষ সমাজব্যবস্থার স্বার্থেই। তৃতীয়ত. রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন যার মাধ্যমে নারীরা পুরুষদের মতো রাজনৈতিক দলগুলোতে সমান সুযোগ লাভের অধিকার পায়।
নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের সরকার বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোতে আমরা নারীদের পদচারণা দেখতে পাই যদিও তা পরিমাণে খুবই স্বল্প। ১৯৭৩ সালের ১ম সংসদে মাত্র ১৫ জন নারী সংসদ সদস্য ছিল, কিন্তু বর্তমানে সংসদে ৭২ জন নারী সংসদ সদস্য রয়েছে যার মধ্যে ২২ জন সরাসরি প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পরিবর্তন ইতিবাচক কিন্তু সংসদে যেভাবে জনগণের আস্থার প্রতিদান দিতে হয় নারী সদস্যরা তা পারছেন কি-না তা যথেষ্ট প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান সংসদে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ উপনেতা, স্পীকার এবং বিরোধীদলীয় নেত্রীসহ ৪ জন মন্ত্রী নারী থাকা সত্ত্বেও সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচনে কেন্দ্র থেকে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নে দেয়া হলেও নারী প্রার্থীর সংখ্যা ছিল অতীব নগণ্য। সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়ার সময়ও নারীর তুলনায় পুরুষের ব্যাপক প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়।
রাজনৈতিক দলগুলোর চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়ামের ১০ জন সদস্যের মধ্যে ৩ জন নারী এবং দলটির সভাপতিও একজন নারী। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ১৭ জন যার মধ্যে নারী সদস্য মাত্র ১ জন, যদিও দলটির সভাপতি একজন নারী। অন্যদিকে বর্তমান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়ামের সদস্য ৩৯ জন, নারী সদস্য মাত্র ৪ জন। এসব জায়গায় নারীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, অবশ্য বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের বাধ্যবাধকতার কারণে রাজনৈতিক দলগুলো নারীদের দলে অন্তর্ভুক্ত করছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ যোগ্যতা এবং প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবার সুযোগকে প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি করছেন। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন গবেষণা সংস্থা ‘দ্য স্ট্যাটিসটিক্স’ তাদের প্রতিবেদনে বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে মনোনীত করেছেন। নারী শিক্ষা ও নারী উদ্যোক্তাদের অগ্রগতি অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারী সংস্থা ‘গ্লোবাল সামিট অব উইমেন’ এর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ’ এ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়েছে। জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত সাধারণ পরিষদের সভায় নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ‘প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ এবং ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ এ্যাওয়ার্ড’ দুটি গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার অর্জনের মাধ্যমে নিজস্ব ব্যক্তিত্ব আর প্রায়োগিক সামর্থ্যকে আরও বেগবান করেছেন তিনি। বিশেষ করে শিশু মৃত্যুর হার রোধকরণ এবং নারীর ক্ষমতায়নে অসামান্য সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। বিশ্ব গণমাধ্যমে শেখ হাসিনার নারীর ক্ষমতায়নের সাফল্য বিশেষ গুরুত্বসহকারে প্রচার করছে ইত্যবসরে। গ্রামীণ নারী, নারী উদ্যোক্তা, মেয়েদের শিক্ষাব্যবস্থা, চাকরিতে নারীর অধিকার, রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ইত্যাদি সেক্টরে ভিন্ন আঙ্গিকে গ্রহণীয় ব্যবস্থা ও সাফল্যের নমুনায়ন দেখিয়ে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা তারা বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো ক্যারিশমেটিক ক্ষমতা দেখিয়ে বিশ্বদরবারে বিশ্বনেতা হিসেবে নিজের আসনকে দিন দিন পাকাপোক্ত করে চলেছেন। তার প্রাপ্তির চিত্র অন্তত সে কথাটিই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে। দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি এবং উন্নয়নের জন্য ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট, জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখায় জাতিসংঘ থেকে চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ, দেশ ও সমাজে শান্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অস্ট্রেলিয়া থেকে ডক্টর অব ল; শান্তি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি, ব্রাসেলস থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী; মানবাধিকার রক্ষায় বিজপোর্ট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী; শান্তি স্থাপনে ইউনেস্কো কর্তৃক হাটপাইয়েট-বোজনি; রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় রানডলপ ম্যাকন উমেনস কলেজ থেকে পিরাল এস বুক-৯৯, ক্ষুধার বিরুদ্ধে আন্দোলনে বিশেষ অবদান রাখায় বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী থেকে সেরেস, ধর্মীয় সম্প্রীতি ও গণতন্ত্র প্রসারে গান্ধী ফাউন্ডেশন, নরওয়ে থেকে গান্ধী পদক লাভ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগ সরকার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে বদ্ধপরিকর বিধায় নারীর ক্ষমতায়নকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে থাকেন, কেননা দেশের অর্ধেক জনসংখ্যাই নারী। ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পরে শেখ হাসিনার সরকার নারীদের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য নানাবিধ কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছিল। সরকারের ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নারীদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকা-ে সম্পৃক্তায়নের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করা হয়। সে পরিকল্পনা মোতাবেক এমডিজি ও সিডও সনদ বাস্তবায়নে সরকার সফলতা দেখায়। মেয়েদের বৃত্তিপ্রদান, গ্রামাঞ্চলে ছাত্রীদের শিক্ষা খরচ অব্যাহতি, মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রদান ইত্যাদি। বিশ্ব লৈঙ্গিক বৈসাদৃশ্য রিপোর্ট ২০১২ অনুযায়ী, বিশ্বে নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্রমে বাংলাদেশের অবস্থান ৮ম স্থানে।
শেখ হাসিনার সরকার সামাজিক নিরাপত্তা উন্নয়ন কর্মসূচীর আওতায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মেইনস্ট্রিমে নিয়ে আসার জন্য বহুমুখী প্রকল্প হাতে নিয়েছেন, যেমন ভিজিএফ, ভিজিডি, দুস্থ নারী ভাতা, মাতৃত্বকালীন এবং দুগ্ধবতী মায়েদের জন্য ভাতা, অক্ষম মায়ের ভাতা, তালাকপ্রাপ্তা ভাতা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী, ৪০ দিনের কর্মসূচী, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প ইত্যাদি। গ্রামের নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য সরকারের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ঋণ দেয়া হয় মাত্র ৫% সেবামূল্যের বিনিময়ে। নারী উদ্যোক্তারা ক্ষুদ্র উদ্যোগ তহবিলের ১০% এবং বাণিজ্যিক খাতের ১০% পেয়ে থাকেন। বর্তমানে ৩০ লাখের বেশি নারী কেবল তৈরি পোশাক কারখানায় তথা গার্মেন্টসে কাজ করেন, এই গার্মেন্টস খাত থেকেই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার অধিকাংশই আসে।
আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগে গৃহীত ব্যবস্থায় নারী উদ্যোক্তাগণ এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিল থেকে বিশেষ সুবিধাযুক্ত ১০% সুদে ঋণ পাচ্ছে। পুনঃঅর্থায়নে তহবিলের ১৫% বরাদ্দ রয়েছে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য। নারীরা ২৫ লাখ পর্যন্ত এসএমই ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন জামানতদার ছাড়াই, কেবলই ব্যক্তিগত পরিচয়ে। পাশাপাশি সরকারী এবং বেসরকারী ব্যাংকগুলো নারীদের সেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে বিশেষ সার্ভিস চালু করেছে ইতোমধ্যে।
শেখ হাসিনার সরকার শিশুর সুস্থ সুন্দর মানসিক বিকাশের জন্য এবং মায়েদের শারীরিক সুরক্ষার জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটিকে চার মাস থেকে বাড়িয়ে ছয় মাস নির্ধারণ করেছে। শিশু মৃত্যুহার ব্যাপক হারে কমিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছে সরকার, ২০১৩ সালে জাতিসংঘের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের জরিপের মাধ্যমে জানা যায়, বাংলাদেশের মাতৃত্বকালীন মৃত্যুহার প্রতি এক লাখ জীবিত জন্মগ্রহণের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে ১৭০টি। এই মাতৃত্বকালীন মৃত্যুহারকে আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতি এক লাখ জীবিত জন্মগ্রহণের বিপরীতে ৬৩টিতে নামিয়ে আনতে পরিকল্পনা ইতোমধ্যে হাতে নেয়া হয়েছে। গ্রামের দুস্থ, প্রান্তিক, দলিত, আদিবাসী এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসার প্রচেষ্টায় সরকার গ্রামভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিকের ব্যবস্থা করেছে। মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার স্কিমের আওতায় একটি ভাউচার প্যাকেজ দেয়া হয় অবহেলিত, বঞ্চিত, নিগৃহীত জনগোষ্ঠীদের যার অধীনে তিনটি প্রসব পূর্ব চেকআপ, দক্ষ দাইয়ের অধীনে নিরাপদ জন্মদান, একটি প্রসব পরবর্তী চেকআপ এবং যাতায়াত খরচ বহন করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে।
শেখ হাসিনার সরকার মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণের ব্যাপারে ব্যাপক জোর দিয়েছেন, কেননা শিক্ষা ব্যতীত ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। বিনামূল্যে ৬ থেকে ১০ বছরের সকল শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা সরবরাহ করা হয়ে থাকে। বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয় মাধ্যমিক পর্যন্ত, দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত সরকারী প্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। স্কুলে মেয়েদের উৎসাহিত করতে এবং ঝরেপড়া কমাতে বৃত্তি দেয়া হয় মেয়েদের। বিভিন্ন উদ্যোগ এবং পদক্ষেপের কারণে মেয়েরা ছেলেদের ন্যায় লৈঙ্গিক সমতায় চলে আসছে শিক্ষার ক্ষেত্রে। যেমন, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে মেয়েদের ভর্তির হার এখন ৫১% এবং মাধ্যমিকে তা ৫৩%, যেখানে ছেলেদের ক্ষেত্রে তা ৪৭%, মাত্র কিছু বছর পেছনে ফিরে দেখা যাবে যখন ছেলেদের ছিল ৬৫% এবং মেয়েদের ছিলো মাত্র ৩৫%।
নারীর সম্পত্তিতে সমান অধিকার ও ব্যবসায়ে সমান সুযোগ সৃষ্টির জন্য সরকার ২০১১ সালে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি পাস করে। যেখানে নারীদের সম্পদের সমান অধিকার এবং ব্যবসায়ের সুযোগ সৃষ্টি করে। পারিবারিক সহিংসতা (দমন এবং নিরাপত্তা) আইন ২০১০ পাস করা হয়, এই আইন নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণের নিয়মপত্র (ঈঊউঅড) এবং সংবিধানের ২৮তম অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা স্পষ্ট করে, যা নারী ও শিশুর উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণকে নিশ্চয়তা দেয়। পাশাপাশি সরকার মানব পাচার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২ এবং পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১১ প্রণয়ন করেছে। দুস্থদের জন্য ৭টি বিভাগে ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারগুলো মেডিক্যাল চিকিৎসা, আইনি সহায়তা, পলিসি সহায়তা এবং আক্রান্তদের পুনর্বাসন সেবা দিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় হাসপাতালে ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাব এবং ডিএনএ স্ক্রিনিং ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে।
বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ সমাজের জন্য একটি ব্যাধি। এ ব্যাধিটিকে নিরসনকল্পে সরকারের সীমাহীন প্রচেষ্টা এমডিজি অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমানে মেয়েদের বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর। প্রচারের কারণে (বাল্যবিবাহের কুফল) অভিভাবকরাও তাদের মেয়েদের সম্পর্কে সজাগ রয়েছেন এবং শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। বাল্যবিবাহ আইন ১৯২৯ সংশোধন হয়েছে এবং সরকার বাল্যবিবাহ সম্পূর্ণ নির্মূলের জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ।
রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নকে আরও জনমুখী করতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যার মধ্যে অন্যতম হলো জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা আরও ৫টি বাড়িয়ে ৫০টি করা হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে নারীদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে মনোনয়ন দেয়ার মাধ্যমে। প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে সরকারের শেষ পর্যায়ের ইউনিয়ন পরিষদেও নির্বাচনে ১২ হাজারের বেশি নারী জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।
জাতিসংঘে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশী বাহিনীর ব্যাপক সুনাম ও চাহিদার প্রয়োজন মেটাতে সরকার এখন বিশ্বের সর্বাপেক্ষা নারী পুলিশ পাঠাচ্ছে মিশনগুলোতে। পারিবারিক সহিংসতা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, নারী ও শিশুদের জন্য নিরাপত্তা, নারী অফিসারদের সুপরামর্শ প্রদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে আামদের নারী পুলিশদের যোগাযোগ বাড়ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১৯০ জন নারী অফিসার শান্তিরক্ষা মিশনে তাদের অর্পিত দায়িত্ব পালন করছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। সম্প্রতি পুলিশের চালুকৃত বিশেষ সেবা সার্ভিস ৯৯৯-তেও নারী পুলিশের অগ্রগণ্য ভূমিকা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যোগ্য পিতার সুযোগ্য সন্তান হয়ে নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বদ্ধপরিকর। কুটিল-কূটশৈল চক্র ১৯ বার জাতির জনকের কন্যাকে হত্যার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু প্রায় সময়েই সৃষ্টিকর্তার অপার কৃপায় বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজকে সুসম্পন্ন করার জন্য দৃঢ়গতিতে এগিয়ে চলছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়। আর এ ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে সুস্থ সুন্দর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় নারীদের আরও আত্মপ্রত্যয়ী, দেশের জন্য উদ্যোমী হওয়ার অনুপ্রেরণা দেবে নিঃসন্দেহে। নারীর ক্ষমতায়নের বীজটি বপন করতে হবে পরিবার থেকেই, তাহলেই এর বাস্তবায়ন দেশের জন্য মঙ্গলময় ও আদর্শিক হবে।