জাতীয়জাতীয় সংবাদশীর্ষ সংবাদ

ডেটলাইন লন্ডন ৮ জানুয়ারি, ১৯৭২ : ব্রিটিশ পুলিশ ও বঙ্গবন্ধু

পাকিস্তান থেকে বঙ্গবন্ধুর লন্ডনে অনির্ধারিত আগমন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে অবাক করলেও তারা তাকে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হিসাবে আনুষ্ঠানিক সম্মান দিয়েছিল। তবে, হিথ্রো বিমানবন্দরে একজন ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারের ‘অনানুুষ্ঠানিক’ মনোভাবের মধ্যে দিয়ে তাঁর জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের শ্রদ্ধা ও উদ্বেগের বিষয়টির প্রতিফলন ঘটেছিল।
পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে মুক্ত হওয়ার কয়েক ঘন্টা পর বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডনে পৌঁছেন। স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে তাঁর অন্যতম শীর্ষ সহযোগী ড. কামাল হোসেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন।
বাসসের সঙ্গে আলাপকালে ড. হোসেন বলেন, ব্রিটিশ কর্মকর্তারা তাদের হিথ্রো বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জের দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় তারা প্রবেশদ্বারে কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারটির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন হঠাৎ স্মার্ট ইউনিফর্ম পরা অফিসারটি স্বাভাবিক প্রটোকল ভেঙে বঙ্গবন্ধুর দিকে এগিয়ে আসেন।
“হঠাৎ করেই বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে জলভরা চোখে তিনি বললেন, ‘স্যার… আমরা আপনার জন্য প্রার্থনা করেছি’ ‘আমি তার কথা ভুলতে পারি না,’’ বলেন ড. হোসেন।

পাকিস্তানি এয়ার মার্শাল
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের ৫১তম বার্ষিকীর এ সময়ে জাতি যখন স্মৃতির অলিন্দে ফিরে দেখছে তখন পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর একজন সাবেক সিনিয়র কর্মকর্তা অত্যন্ত জীবন্তভাবে কীভাবে বাংলাদেশের স্থপতি নয় মাস বন্দিত্বের পরে সেদেশ থেকে বেরিয়ে আসেন তা চিত্রিত করেছেন।
পাকিস্তান বিমান বাহিনির সাবেক প্রধান এয়ার মার্শাল জাফর এ চৌধুরী, যিনি সে সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের (পিআইএ) চেয়ারম্যান ছিলেন, তার স্মৃতিচারণে লিখেছেন যে তিনি বঙ্গবন্ধুকে রাওয়ালপিন্ডির চাকলালা বিমানবন্দর থেকে লন্ডনে নিয়ে গিয়েছিলেন।
তিনি স্মরণ করেন যে সবেমাত্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হিসাবে ক্ষমতা গ্রহণকারী জুলফিকার আলী ভুট্টো বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বিদায় জানিয়েছিলেন। চৌধুরী বলেন, দূর থেকে বাংলাদেশের স্থপতির পাকিস্তানি নেতার সাথে তার শেষ কথা বিনিময় করতে দেখার উত্তেজনা এখনও যেন তার ভেতরে বিরাজ করছে।
তার মতে, পিআইএ ফ্লাইটটি উড্ডয়নের পরেও উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি আরও কয়েক ঘণ্টা অব্যাহত ছিল। বিমানটি পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের অধীনে থাকায় একটি অস্বস্তিকর অনুভূতি দৃশ্যত বঙ্গবন্ধুকে আঁকড়ে ধরেছিল।
চৌধুরী বর্ণনা করেছেন যে ডিনার পরিবেশনের পরে পরিস্থিতি দৃশ্যত সহজ হয়ে যায়। যখন তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে তাঁর পরিচয় দেন এবং এরপর তিনি নিজেই কথা বলতে থাকেন, আবেগের সাথে তাঁর প্রতি বাঙালিদের ভালবাসার বর্ণনা দেন।
তৎকালীন পিআইএ প্রধান স্মরণ করেন যে সকালের নাশতাটি খুব ভোরে পরিবেশন করা হয় এবং পরে একজন স্টুয়ার্ড পিআইএর পক্ষ থেকে ‘সম্মানিত অতিথি’র জন্য উপহার হিসেবে দুটি পাইপ ও একটি জায়নামাজ নিয়ে আসেন। বঙ্গবন্ধু তখন দাঁড়িয়ে উপহার গ্রহণ করেন এবং তাঁর সাথে করমর্দন করেন।
চৌধুরী স্মরণ করেন যে বঙ্গবন্ধু তখন তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে হিথ্রো বিমানবন্দরে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিনিধির উপস্থিতি চাইতে বলেন এবং সে অনুরোধের সাথে সঙ্গতি রেখে তিনি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে একটি বার্তাও পাঠান।
চৌধুরী লিখেছেন, ‘সকাল ৬ টার দিকে আমরা লন্ডনে অবতরণ করি এবং বিমানটিকে মূল টার্মিনাল থেকে কিছুটা দূরে রাখি। কেননা বিমানে কিছু কর্মকর্তা উঠেছিলেন।’ চৌধুরী ডিসেম্বর, ২০১৯-এ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
এয়ার মার্শাল স্মরণ করলেন, ‘আমি শেখ মুজিবকে বললাম, এরা ভিআইপিদের প্রটোকল কর্মকর্তা এবং তারা আপনাকে ভিআইপি লাউঞ্জে নিয়ে যাবেন। সেখানে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তারা আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।’
তিনি বলেন যে তিনি ভিআইপি লাউঞ্জের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু তাকে জিজ্ঞাসা করেন যে তিনি লন্ডনে তার কয়েকজন বন্ধুকে ফোন করার জন্য তার কাছে সাহায্য চাইতে পারেন কি-না। এঁদের বেশিরভাগই ছিলেন বাঙালি রেস্তোরাঁর মালিক। কিন্তু, সেই সকাল বেলায় আউটলেটগুলো তখনও বন্ধ ছিল। ফলে, কেউ ফোন ধরেননি।
তবে তিনি স্মরণ করেন যে অবশেষে বঙ্গবন্ধুর এক পারিবারিক বন্ধু মাহমুদ হারুন ফোন রিসিভ করলে ‘আমি নীরবে সরে যাই, তাই আমি তাদের কথোপকথন শুনতে পাইনি।
চৌধুরী লিখেছেন ‘শেখ মুজিব (তখন) আমাকে বলেন, এয়ার মার্শাল, আপনি আমার জন্য যা করেছেন তার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, এখন আমি আমার লোকদের সাথে দেখা করব যারা বাংলাদেশ মিশন থেকে এসেছেন কারণ আমি তাদের নেতা – জনগণের মানুষ।’

পাক হাইকমিশনার
কামাল হোসেন বলেন, ব্রিটেনে পাকিস্তানের তৎকালীন হাইকমিশনার নাসিম আহমেদ বিমান বন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে উপস্থিত ছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেন, তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে তিনি এখানে এসেছেন।

‘স্যার, আমি আপনাকে অভ্যর্থনা জানাতে এখানে এসেছি। দয়া করে আমাকে যদি বলতেন আমি আপনার জন্য  কী করতে পারি’। ড. হোসেন স্মরণ করেন, জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আপনি যথেষ্ট করেছেন, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’
সাদারল্যান্ড
ড. হোসেন বলেন, হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছানোর কয়েক মিনিটের মধ্যে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধি স্যার ইয়েন সাদারল্যান্ড সেখানে পৌঁছান এবং বাংলাদেশের স্থপতিকে তার সরকারের পক্ষ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান।
হোসেনের মতে, ব্রিটিশ সরকার ক্ল্যারিজ হোটেলে বঙ্গবন্ধুর থাকার ব্যবস্থা করেছিল। যেখানে সাধারণত বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানদের থাকার ব্যবস্থা করা হতো।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু এই আয়োজনের জন্য তাদের ধন্যবাদ জানান, কিন্তু তাঁর এই সংক্ষিপ্ত সময় অবস্থানের জন্য অপেক্ষাকৃত মাঝারি মানের একটি হোটেলের ব্যবস্থা করা যায় কিনা-যাতে ব্রিটেনে বসবাসকারী সাধারণ বাঙালিরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারেন-তা জিজ্ঞেস করেন।
‘স্যার, আমি এই একটি জিনিসেরই ব্যবস্থা করতে পারবো না, কারণ, কেবল ক্ল্যারিজ হোটেলেই রাষ্ট্র প্রধানদের নিরাপত্তা প্রদানের ব্যবস্থা আছে। তবে, নিরাপত্তা বজায় রেখে আগ্রহী যে কোন সংখ্যক মানুষ যাতে আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারে তা আমরা দেখব,’ সাদারল্যান্ডকে উদ্ধৃত করেন ড. হোসেন।
নিউজউইক পত্রিকার ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি সংস্করণে লিখেছে, কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে, মধ্যরাতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সশস্ত্র প্রহরায় মুজিবকে রাওয়ালপিন্ডি বিমানবন্দরে নিয়ে যান এবং তাকে একটি বিশেষ বিমানের বৈদেশিক ফ্লাইটে তুলে দেন।
‘মুজিব ফ্লাইস টু ফ্রিডম’ শিরোনামে নিউজউইকে লেখা হয়, মুজিবের বিমানটি লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছেছে এবং পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান গত বসন্তে তাকে কারাগারে পাঠানোর পর বিশ্ব এই প্রথম ৫১ বছর বয়সী এই বাঙালি নেতাকে দেখতে পাচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *