রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘ ও বিশ্ব নেতাদের কার্যকর ভূমিকা কামনা প্রধানমন্ত্রীর
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘ (ইউএন) এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, সমস্যা অব্যাহত থাকলে, তা এই অঞ্চল এবং এর বাইরেও স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করতে পারে।
‘মিয়ানমারে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সশস্ত্র সংঘাত বাস্তচ্যূত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে আরও দুরূহ করে তুলেছে। আশা করি, এ বিষয়ে জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা রাখবে,’ প্রধানমন্ত্রী আজ তাঁর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে (ইউএনজিএ) প্রদত্ত ভাষণে বলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ^ নেতাদের সভায় বলেন, ‘আমি এখন আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করবো মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দিকে। গত মাসে ২০১৭ সালে স্বদেশ থেকে বাস্তুচ্যূত হয়ে তাদের গণহারে বাংলাদেশে প্রবেশের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে।’
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরিতে দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক এবং জাতিসংঘসহ অন্যান্য অংশীজনদের নিয়ে আলোচনা সত্ত্বেও একজন রোহিঙ্গাকেও তাদের মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠানো যায়নি। মিয়ানমারে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সশস্ত্র সংঘাত বাস্তচ্যূত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে আরও দুরূহ করে তুলেছে। আশা করি, এ বিষয়ে জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
শুক্রবার স্থানীয় সময় বিকেলে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) অধিবেশনে তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পদাংক অনুসরণ করে বাংলায় প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব নেতাদের প্রতি তাঁর আহ্বানে আরো বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে অনিশ্চয়তা সর্বস্তরে হতশার সৃষ্টি করছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। তাদের প্রত্যাবাসনের অনিশ্চয়তা সর্বস্তরে ব্যাপক হতাশার সৃষ্টি করেছে। মানবপাচার ও মাদক চোরাচালানসহ আন্তঃসীমান্ত অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি এ পরিস্থিতি উগ্রবাদকেও ইন্ধন দিতে পারে। এ সঙ্কট প্রলম্বিত হতে থাকলে তা এই উপমহাদেশসহ বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর মারাতœক প্রভাব ফেলতে পারে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশন ১৩ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে সংস্থার সদর দফতরে কোভিড-১৯ মহামারী প্রাদুর্ভাবের পর এই প্রথম ১৯৩টি সদস্য দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সশরীরে উপস্থিতির মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, এই অধিবেশন এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন, সহিংসতা ও সংঘাত, কোভিড-১৯ মহামারির মত একাধিক জটিল এবং বহুমাত্রিক প্রতিকূলতায় পৃথিবী নামক আমাদের এই গ্রহ আজ জর্জরিত। মানবিক চাহিদা গভীর হচ্ছে, জলবায়ু লক্ষ্যগুলি মূলত অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে, বৈষম্য আরও প্রকট হচ্ছে।
তিনি বলেন, বিশ্ব নেতারা সাধারণ পরিষদ হলে ব্যক্তিগতভাবে বিবৃতি বিনিময় করবেন, ‘একটি সঙ্কটপূর্ণ সন্ধিক্ষণ: আন্তঃসংযুক্ত প্রতিকূলতাসমূহের রূপান্তরমূলক সমাধান।’ শীর্ষক এবারের প্রতিপাদ্যটি এ সকল প্রতিকূলতা মোকাবিলায় এবং আমাদের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করে শান্তিপূর্ণ ও টেকসই পৃথিবী গড়ে তোলার উপায় খুঁজে বের করার জন্য সকলের ঐক্যবদ্ধ আকাক্সক্ষার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। আর এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের এখনই সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে।
শেখ হাসিনার ভাষণে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, শান্তি ও স্থিতিশীলতা, জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, কোভিড-১৯ মহামারী, ফিলিস্তিন এবং অভিবাসন বিষয়ক বৈশ্বিক ও বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখযোগ্যভাবে স্থান পেয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব শান্তি নিশ্চিত করতে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে সংঘাতের অবসানে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তিতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, যুদ্ধ বা একতরফা জবরদস্তিমূলক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা-নিষেধাজ্ঞার মতো বৈরীপন্থা কখনও কোন জাতির মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। পারস্পরিক আলাপ-আলোচনাই সঙ্কট ও বিরোধ নিষ্পত্তির সর্বোত্তম উপায়। তাই, আমরা ইউক্রেন ও রাশিয়ার সংঘাতের অবসান চাই। নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা-নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে একটি দেশকে শাস্তি দিতে গিয়ে নারী, শিশুসহ ও গোটা মানবজাতিকেই শাস্তি দেওয়া হয়। তাই, বিশ্ব বিবেকের কাছে আমার আবেদন, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, যুদ্ধ, স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা) বন্ধ করুন। শান্তি প্রতিষ্ঠা করুন। তাই যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই, মানবকল্যাণ চাই।
তিনি বলেন, যুদ্ধের ভয়াবহতা, হত্যা-ক্যু-সংঘাতে মানুষের যে কষ্ট-দুঃখ-দুর্দশা হয়, ভুক্তভোগী হিসেবে আমি তা উপলদ্ধি করতে পারি। তাই যুদ্ধ চাই নে, শান্তি চাই; মানবকল্যাণ চাই। মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি চাই। আগামী প্রজন্মের জন্য শান্তিময় বিশ্ব, উন্নত-সমৃদ্ধ জীবন নিশ্চিত করতে চাই।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার আকুল আবেদন, যুদ্ধ, অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করুন। সমুন্নত হোক মানবিক মূল্যবোধ।’