জাতীয়জাতীয় সংবাদপ্রধানমন্ত্রীশীর্ষ সংবাদ

ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের, ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি

নড়াইলে নির্মিত দেশের প্রথম ৬ লেন বিশিষ্ট মধুমতি সেতু শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থাই বদলে দেবে না, ব্যবসা-বাণিজ্যেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। এর সুফল পাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ পুরো দেশের মানুষ। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ এবং ভারতীয় পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই সেতু।

নড়াইল-যশোরের ব্যবসায়ীরা বলেন, এই অঞ্চলে মৌসুমি শাক-সবজি, ফল-মূল, খাদ্যশস্য, ফুল এবং মাছ উৎপাদন হয় ব্যাপক পরিসরে। তা ছাড়া ভারতীয় বিভিন্ন ধরনের পণ্য দেশের বৃহত্তর বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এসব পণ্য ও জিনিসপত্র সড়কপথে সারা দেশে সরবরাহ করা হয়। পণ্য সরবরাহ চেইনে এখন মধুমতি সেতু পরিবর্তন আনবে, পুরো ব্যবস্থা গতিশীল হবে। কম সময়ে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। পচনশীল পণ্য নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে।

নড়াইলের লোহাগড়ায় মধুমতি নদীর কালনা পয়েন্টে ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্কের আওতায় মধুমতি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে ৬৯০ মিটার দীর্ঘ সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৯৬০ কোটি টাকা।

ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের, ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি
সোমবার (১০ অক্টোবর) দুপুরে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সেতুটির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর নড়াইলে সুলতান মঞ্চের জনসভায় এখানে একটি সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, নড়াইল-যশোরসহ এই অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় শীতকালীন শাক-সবজি উৎপাদন হয়। অন্যান্য ফসলেরও উর্বর ক্ষেত্র অঞ্চলটি। যা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এসব পণ্য মূলত মাগুরা হয়ে এবং কালমা ফেরি হয়ে ট্রাকযোগে পরিবহন করা হয় হতো এতদিন। ফলে দীর্ঘ যানজটে পচনশীল অনেক পণ্য নষ্ট হতো কিংবা তাজা চেহারা উবে যেতো। এখন পণ্য পরিবহনের বেশিরভাগই হবে মধুমতি সেতু দিয়ে পরিবহন করা হবে। এতে সময় বাঁচবে এবং ভোগান্তিও কমবে।

রিয়াজুল ইসলাম নামে নড়াইল সদরের এক শাক-সবজি ব্যবসায়ী বলেন, নিজ জেলা ও পার্শ্ববর্তী যশোর থেকে আসা পণ্য তিনি ঢাকার কাওরান বাজারে পাঠিয়ে থাকেন। আগে মাগুরা হয়ে পণ্যভর্তি ট্রাক পাঠাতেন। এখন থেকে মধুমতি সেতু দিয়ে পণ্য পাঠানো হবে। সময় সাশ্রয় হবে, ট্রাক ভাড়াও কমবে।

ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের, ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি
ভারত থেকে আমদানি করা পণ্য বিপণনকারী তমিজউদদীন বললেন, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচসহ নানা ধরনের পণ্য আসে দেশে। বেনাপোল দিয়ে এসব পণ্যের একটি বড় অংশ আনা হয়। যার অনেকাংশ মাগুরা হয়ে ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলে যায়। এখন ওই রুটের বদলে মধুমতি সেতু দিয়ে যাবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এটি একটি পরিবর্তন আনবে।

নড়াইলের মাদ্রাসা বাজারের শিমু শারমিন বলেন, আমরা ঢাকায় থাকি। প্রায়ই বাড়িতে আসা হয়। ফেরিতে ভোগান্তি হতো। এখন পদ্মা সেতু ও মধুমতি সেতু হওয়ায় সুবিধা হলো। নড়াইলবাসী এবং ঢাকায় থাকা নড়াইলের মানুষের জন্য এটি আনন্দের বিষয়।

এ ছাড়াও সেতুর কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসায় স্থানীয় ক্ষুদ্র ও কুঁটির শিল্প বেগবান হবে। ছোট-বড় উদ্যোক্তার সংখ্যাও বাড়বে। সরকপথে যাতায়াত বাড়বে। নতুন নতুন গণপরিবহন নামবে। সব মিলিয়ে সামগ্রিক অর্থনীতিতে হাওয়া লাগবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।

তবে কালনা ফেরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঘাটসংলগ্ন কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিপাকে পড়েছে। এর সঙ্গে যুক্তদের বিকল্প আয়ের উৎস খুঁজতে হবে। ঘাট সংলগ্ন মূল সড়কের পাশে ৫ বছর ধরে মুদি দোকান করছেন পঞ্চাশোর্ধ মো. লিয়াকত আলী। তিনি বলছিলেন, ‘সংসার চালাই এই দোকান করে। এখন আর এটি সেভাবে চলবে না। তা নিয়ে শঙ্কা থাকলেও মানুষের উপকার হবে এটাই বড় বিষয়।’

প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই সেতু নড়াইল, গোপালগঞ্জ, খুলনা, মাগুরা, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর ও ঝিনাইদহ জেলাকে সংযুক্ত করেছে। এই সেতুর সরাসরি সুফল পাবে খুলনা বিভাগের ১০টিসহ আরও কয়েকটি জেলার লাখ লাখ মানুষ।

তারা আরও জানান, সেতুটির কারণে ঢাকা থেকে নড়াইলের দূরত্ব কমে আসবে ১১৫ কিলোমিটার। একই দূরত্ব কমবে কলকাতার ক্ষেত্রেও। আশপাশের অন্যান্য জেলার ক্ষেত্রে দূরত্ব কমবে ৯০-৯৮ কিলোমিটার। এই সেতু দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতে সময় ও অর্থ বাঁচাবে। এ ছাড়া দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোলের সঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রামের দূরত্বও কমবে, সাশ্রয় হবে সময়। এর ফলে দেশের অভ্যন্তরে এবং প্রতিবেশী দেশে ভ্রমণ ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে।

ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের, ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি
নড়াইলের জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘মধুমতি সেতু পুরো দেশের আর্থ-সামাজিক, ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভূত উন্নতি সাধন করবে। এই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সব অংশীজন, মধুমতি নদীর দুই পাড়ের ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সোমবার সকালের জন্যে অপেক্ষা করছেন। সেতুটি তাদের জীবনমান বদলে দেবে। ঢাকাসহ সারা দেশের যোগাযোগের ক্ষেত্রে নড়াইল হাব হিসেবে পরিচিতি পেতে যাচ্ছে।’

সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এবং প্রকল্পটির পরিচালক শ্যামল ভট্টাচার্য বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের পর আজ রাত ১২টায় যান চলাচলের জন্য জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। পদ্মা সেতুর সুফল পুরোপুরি পেতেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই অঞ্চলের স্থলবন্দরসহ অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্যও সেতুর কানেকশন জরুরি ছিল। এই অঞ্চলের সাব-রিজিওনাল কানেক্টিভিটি মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করবে মধুমতি সেতু।’

নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) মাশরাফি বিন মুর্তজা বলেন, ‘নড়াইলসহ এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের চাওয়া ছিল কালনা পয়েন্টে একটি সেতু হোক। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তাদের সেই চাওয়া পূরণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে এজন্য আমার এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এই সেতুর সুফল পাবে এই অঞ্চলের লাখো মানুষ। যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ভূমিকা রাখবে।’

একই দিন নারায়ণগঞ্জের সদর ও বন্দর উপজেলাকে সংযুক্ত করা তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম নাসিম ওসমান নামকরণ করা সেতুটির উদ্বোধন হয়। সেতুটি নারায়ণগঞ্জের পাশাপাশি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *