কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রাণহানি ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা হবে : প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে হত্যা ও অন্যান্য অপ্রীতিকর ঘটনার সুষ্ঠু বিচার ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, “হত্যাকান্ডসহ যে সকল অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে, সুষ্ঠু বিচারের ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে সে সকল বিষয়ের বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা হবে।”
তিনি আরও বলেন,“আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করছি, যারা হত্যাকান্ড, লুটপাট ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়েছে এরা যেই হোক না কেন, তারা যেন উপযুক্ত শাস্তি পায় সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া তাঁর এক টেলিভিশন ভাষণে একথা বলেন। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের কোটা বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সৃষ্ট সংঘাতময় পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে তিনি এই ভাষণ প্রদান করেন।
তিনি তাঁর ভাষণে সুপ্রিম কোর্টের রায় পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার জন্য সবাইকে বিশেষ অনুরোধ জানান এবং আদালতে ছাত্রসমাজ ন্যায় বিচারই পাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন
তিনি বলেন, “সর্বোচ্চ আদালতের রায় আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার জন্য আমি সকলকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি। আমার বিশ্বাস আমাদের ছাত্র সমাজ উচ্চ আদালত থেকে ন্যায় বিচারই পাবে, তাদের হতাশ হতে হবে না।”
প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ঘিরে সৃষ্ট ঘটনাকে খুবই বেদনাদায়ক ও দু:খজনক আখ্যায়িত করে প্রাণহানীর ঘটনায় গভীর দু:খ প্রকাশ করেন। তিনি শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি তাঁর সমবেদনা ব্যক্ত করেন এবং ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান।
তিনি বলেন, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো কিছু মহল এই আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে অনাকাঙ্খিত উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে সন্ত্রাসী কর্মকা-ে লিপ্ত হয়। এরফলে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ঘিরে যে সকল ঘটনা ঘটেছে তা খুবই বেদনাদায়ক ও দু:খজনক। অহেতুক কতগুলো মূল্যবান জীবন ঝরে গেল।
শেখ হাসিনা বলেন,“আপনজন হারাবার বেদনা যে কত কষ্টের তা আমার থেকে আর কে বেশি জানে? যারা মুত্যুবরণ করেছে তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। যারা হত্যাকা-ের স্বীকার হয়েছে তাদের পরিবারের জীবনজীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে যে সহযোগিতা দরকার তা আমি করব।”
তিনি আন্দোলনরত কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সন্ত্রাসীরা যেকোনো সময়ে সংঘাতের পরিবেশ তৈরি করে তাদের ক্ষতিসাধন করতে পারে।
‘তাই শিক্ষার্থীদের পিতা-মাতা, অভিভাবক এবং শিক্ষকদের প্রতি আমার আবেদন, তারা যেন তাদের সন্তানদের নিরাপত্তার বিষয়ে সজাগ থাকেন। একইসাথে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টিতে বিশেষভাবে নজর রাখেন’।
জাতির পিতার কন্যা বলেন, আমি বিশ্বাস করি যারা কোটা সংস্কার আন্দোলনে জড়িত তাদের সাথে এই সকল সন্ত্রাসীদের কোন সম্পর্ক নেই। বরং সন্ত্রাসীরা এদের মধ্যে ঢুকে সংঘাত ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।
তিনি বলেন, আমি দ্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করছি, যারা হত্যাকা-, লুটপাট ও সন্ত্রাসী কর্মকা- চালিয়েছে এরা যেই হোক না কেন, তারা যেন উপযুক্ত শাস্তি পায় সে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আমি আরও ঘোষণা করছি, হত্যাকা-সহ যে সকল অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে, সুষ্ঠু বিচারের ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে সে সকল বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা হবে।
সরকার প্রধান বলেন, কাদের উস্কানিতে সংঘর্ষের সূত্রপাত হলো, কারা কোন উদ্দেশ্যে দেশকে একটি অরাজক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিল, তা তদন্ত করে বের করা হবে।
সরকারি চাকরীতে কোটার বিষয়ে সরকার প্রধান বলেন, ২০১৮ সালে ছাত্র সমাজের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সরকারি চাকুরিতে কোটা প্রথা বাতিল করে একটা পরিপত্র জারি করে। পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা বহাল রাখার পক্ষে উচ্চ আদালত সরকারের জারি করা পরিপত্র বাতিল করে দেয়।
তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে পরিপত্র বহাল রাখার জন্য সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করা হয় এবং আদালত শুনানির দিন ধার্য করে। আদালত শিক্ষার্থীদের কোন বক্তব্য থাকলে তা শোনার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের সুযোগ রয়েছে। এ সময় আবার ছাত্ররা কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করে।
সরকার প্রধান বলেন, এটি আইনি প্রক্রিয়ায় সমাধানের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রাস্তায় আন্দোলনে নেমে দুষ্কৃতিকারীদের সংঘাতের সুযোগ করে দেবেন না।
শেখ হাসিনা বলেন, কোটা বিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই সরকার যথেষ্ট ধৈর্য ও সহনশীলতা প্রদর্শন করেছে। বরং আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে পুলিশ সহযোগিতা করে। রাষ্ট্রপতির কাছে যখন আন্দোলনকারীরা স্মারকলিপি প্রদান করার ইচ্ছা প্রকাশ করে, সে ক্ষেত্রেও তাদের সুযোগ করে দেয়া হয় এবং নিরাপত্তারও ব্যবস্থা নেয়া হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, আমি প্রতিটি হত্যাকা-ের নিন্দা জানাই। যে সকল ঘটনা ঘটেছে তা কখনই কাম্য ছিল না। চট্টগ্রামে সন্ত্রাসীরা বহুতল ভবনের ছাদ থেকে ছাত্রদের হত্যার উদ্দেশ্যে নির্মমভাবে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। অনেক ছাত্রের হাত পায়ের রগ কেটে দেয়। তাদের উপর লাঠিপেটা এবং ধারালো অস্ত্র দ্বারা আঘাত করে, একজন মৃত্যুবরণ করেছে, অনেকে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। ঢাকা, রংপুর এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বাসভবন ও ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসিক হলে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়।
তিনি বলেন, সাধারণ পথচারী, দোকানীদের আক্রমণ, এমনকি রোগীবাহী এম্বুলেন্স চলাচলে বাধা প্রদান করা হয়। মেয়েদের হলে ছাত্রীদের উপর আক্রমণ করা হয়েছে এবং লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। আবাসিক হলে প্রভোস্টদের হুমকি দেয়া হয় এবং আক্রমণ করা হয়েছে। শিক্ষকদের উপর চড়াও হয়ে তাদের গায়ে হাত তোলা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতার শুরুতে পবিত্র আশুরার বিয়োগান্তক অধ্যায় স্মরণ করে ’৭৫ এ জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা এবং মুক্তিযদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ ও নির্যাতিতা ২লাখ মা-বোনকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।
তিনি বলেন, আজকে অত্যন্ত বেদনা-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। বাংলাদেশের মানুষ যখন একটু স্বস্তি-শান্তিতে ফিরে, তখন মাঝে-মধ্যে এমন কোন ঘটনা ঘটে যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
তিনি বলেন, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের অর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছি। বিগত ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ব্যবহার এবং মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষার ব্যবস্থা করে জনগণকে উন্নত জীবন দেয়ার যাত্রা শুরু করেছি। অনেক সাফল্যও অর্জন করেছি। বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে একটা মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছি। তারপরও আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে।
তিনি আবারও এই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের জন্য গভীর দুঃখ প্রকাশ করে পরিবারের সদস্যদেও প্রতি গভীর সমবেদনা জানান এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আামাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে সকলের সহযোগিতায় স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকারও পুনর্ব্যক্ত করেন।