নির্মাণ সামগ্রীর দাম সমন্বয় করে প্রকল্পের ‘রেট শিডিউল’ পুনঃনির্ধারণের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্মাণসামগ্রীর পরিবর্তিত মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উন্নয়ন প্রকল্পের বিভিন্ন কাজের ‘রেট শিডিউল’ সংশোধনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ প্রদান করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী উন্নয়ন প্রকল্পের খসড়া তৈরির আগে মার্কিন ডলারের সর্বশেষ বিনিময় হার বিবেচনায় নেওয়ারও পরামর্শ দেন। কেননা মার্কিন ডলারের বিনিময় হার প্রায়শই প্রকল্পের সামগ্রিক ব্যয়কে প্রভাবিত করে। মঙ্গলবার রাজধানীর শেরেবাংলানগরে এনইসি সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় তিনি এ নির্দেশনা প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রী সভায় সভাপতিত্ব করেন।
বৈঠকশেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি বলেন, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন লোহা, সিমেন্ট, পাথর ও ইটের মতো নির্মাণসামগ্রীর মূল্যের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যার ফলে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়নের সময়ের ‘রেট শিডিউল’এর তুলনায় প্রায়শই দেখা যায় বাস্তবায়ন সময়কালে নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে গেছে, যেটি ক্রমবর্ধমান বিশ্ব অর্থনীতিতে ঘটে বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন। শেখ হাসিনা এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজন অনুযায়ী মূল্য নির্ধারণ (রেট শিডিউল) ও নির্মাণসামগ্রীর মূল্য পরিবর্তন করতে বলেছেন।
মার্কিন ডলারের বিনিময় হার উন্নয়ন প্রকল্পের সামগ্রিক ব্যয়কে প্রভাবিত করে উল্লেখ করে এম এ মান্নান বলেন, প্রধানমন্ত্রী প্রকল্পসমূহের সামগ্রিক ব্যয় বা অনুমিত আর্থিক ব্যয় চূড়ান্ত কার ক্ষেত্রে ডলারের সর্বশেষ বিনিময় হারকে সমন্বয় করার পরামর্শ দেন। মান্নান আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহকে এ বিষয়টি সমাধানের জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশ প্রদান করেছেন’। পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী সুপ্রীম কোর্টে বিচারাধীন কর সংক্রান্ত মামলাসমূহ নিস্পত্তির জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ প্রদান করেছেন এবং বলেছেন মামলা নিস্পত্তির মাধ্যমে কর আদায় ও রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে সমৃদ্ধ করতে হবে।
উড়িরচর-নোয়াখালী ক্রস ড্যাম নির্মাণ প্রকল্পের কথা উল্লেখ করে এম এ মান্নান বলেন, প্রধানমন্ত্রী এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে বিশেষ সতর্ক থাকতে বলেছেন, কারণ এই প্রকল্পের সঙ্গে উপকূলীয় এলাকা সম্পৃক্ত রয়েছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী সতর্ক করে দিয়েছেন যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময় পার্শ্ববর্তী দ্বীপ, জায়গা এবং চ্যানেলগুলো যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
মৌসুমি ফল ও সবজি সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের মতো দেশ ফল সংরক্ষণ ও বোতলজাত করে ব্যবসা এবং রপ্তানিতে সফল হয়েছে। বাংলাদেশেও এ ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। একই এলাকায় যেন দ্বৈত প্রকল্প গ্রহণ না করা হয় সেজন্য প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের আরও সতর্ক থাকতে বলেন এবং সমন্বিতভাবে কাজ করার নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্বৃত্ত করে এম এ মান্নান বলেন,‘ওভার ল্যাপিং হলে টাকার অপব্যবহার হতে পারে।’
‘আমার গ্রাম- আমার শহর: পাইলট গ্রাম উন্নয়ন’ প্রকল্পের কথা উল্লেখ করে পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, শেখ হাসিনা বলেছেন, এটি একটি পাইলট প্রকল্প এবং ভবিষ্যতে এই প্রকল্পের অভিজ্ঞতা কাজে লাগতে পারে। তবে, তিনি বলেছেন সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহ সমন্বিতভাবে কাজ করলে, একই নামে ভবিষ্যতে এ ধরনের আর কোন প্রকল্প নেওয়া লাগবে না। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, একনেক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীকে সাক্ষরতা মূল্যায়ন (লিটারেসি এ্যাসেসমেন্ট) এবং আইসিটি ব্যবহার বিষয়ে বিবিএস এর দুটি জরিপের ফলাফল সম্পর্কে অবহিত করা হয়। এতে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন।
৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘আমার গ্রাম-আমার শহর: পাইলট গ্রাম উন্নয়ন’ প্রকল্প অনুমোদন :
গ্রামে আধুনিক নাগরিক সুবিধা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে মঙ্গলবার একনেক সভায় ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘আমার গ্রাম- আমার শহর: পাইলট গ্রাম উন্নয়ন’ প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। পরিকল্পনা বিভাগের সচিব সত্রজিৎ কর্মকার বলেন, একটি সমীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে এই প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে।
বৈঠকশেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ব্রিফিংয়ে জানান, একনেক সভায় মোট ১৫টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ১৮ হাজার ১০ কোটি ১২ লাখ টাকা। মোট বাস্তবায়ন খরচের মধ্যে সরকারের অর্থায়ন থাকবে ১২ হাজার ১৯২ কোটি ৭ লাখ টাকা, বৈদেশিক অর্থায়ন ৫ হাজার ২৩৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন রয়েছে ৫৮৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা। অনুমোদিত ১৫ প্রকল্পের মধ্যে ১৪টি নতুন এবং ১্িট সংশোধিত প্রকল্প রয়েছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন,‘আমার গ্রাম- আমার শহর: পাইলট গ্রাম উন্নয়ন’ প্রকল্পটি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই) যৌথভাবে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। পাইলট ভিত্তিতে দেশের নির্বাচিত ১৫টি গ্রামে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পের লক্ষ্য হলো- ১৫টি গ্রামে আধুনিক নাগরিক সুবিধা সম্প্রসারণ করা এবং দেশের সকল গ্রামকে ধীরে ধীরে আধুনিক নাগরিক সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা।
অনুমোদিত অন্য প্রকল্পসমূহ হলো- বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘বড় পুকুরিয়া-বগুড়া-কালিয়াকৈর ৪০০ কেভি লাইন’ প্রকল্প, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফিল্ম সিটি (২য় পর্যায়)’, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ‘সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (এসএমইউ) স্থাপন’, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ‘জিনাই, ঘাঘট, বংশী এবং নাগদা নদীর প্রবাহ পুনরুদ্ধারের জন্য শুষ্ক মৌসুমে নদীর প্রবাহ নিশ্চিতকরণ, নৌ-পথের উন্নয়ন ও বন্যা ব্যবস্থাপনা’,সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের ‘উলিপুর (হেলিপ্যাড মোড়)-চিলমারি (গুনাইগাছ) সংযোগ সড়ক নির্মাণ’, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ‘বেসরকারি ভবনসমূহের রেজিলিয়িন্সির (স্থিতিস্থাপকতা/সহনশীলতা) জন্য ডিজাইন এবং নির্মাণ এর গুণগত মান বৃদ্ধিকরণ’, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে সমন্বিত ও টেকসই পৌর পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন’, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের জন্য রেকর্ড ভবন নির্মাণ’, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ৩টি প্রকল্প যথাক্রমে ‘বরিশাল, ভোলা, ঝালকাঠি ও পিরোজপুর জেলা সেচ উন্নয়ন প্রকল্প’, ‘ডাবল লিফটিং পদ্ধতিতে পদ্মা নদীর পানি বরেন্দ্র এলাকায় সরবরাহ ও সেচ সম্প্রসারণ’ এবং “টিস্যু কালচার ল্যাবরেটরি কাম হর্টিকালচার সেন্টার স্থাপন ও উন্নয়ন,’ পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ২টি প্রকল্প ‘ভূমি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে উড়িরচর নোয়াখালী ক্রস ড্যাম নির্মাণ’ প্রকল্প এবং ‘চট্টগ্রাম জেলার সনদ্বীপ উপজেলাস্থ পোল্ডার নং-৭২ এর ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের স্থায়ী পুনর্বাসনসহ ঢাল সংরক্ষণ’, এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ‘দেশের বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে নতুন খাদ্য গুদাম ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ’।