ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন
দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হচ্ছে মঙ্গলবার (২৪ জানুয়ারি)। নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) আগামী ২২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এ নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। সেক্ষেত্রে ফেব্রুয়ারির ১৯ বা ২০ তারিখকে ভোটগ্রহণের তারিখ হিসেবে চূড়ান্ত করে ৪ বা ৫ ফেব্রুয়ারি তফসিল ঘোষণা হতে পারে। নির্বাচন কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বর্তমান রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হবে আগামী ২৩ এপ্রিল। সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান রয়েছে। এতে রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। তবে যে সংসদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছে, ওই সংসদের মেয়াদে রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হলে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনের প্রয়োজন পড়বে না। সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রথম বৈঠকের দিন থেকে ৩০ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্রপতির মৃত্যু, পদত্যাগ বা অপসারণের ফলে পদ শূন্য হলে শূন্য হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে।
সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের যাবতীয় প্রস্তুতি শুরু করেছে। তারা ভোটার তালিকা প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছে।
জানা গেছে, তফসিল ঘোষণার উপযোগী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইসির পরিকল্পনা ছিল। তবে আগামী ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় সংসদের ছয়টি আসনের উপনির্বাচনের কারণে তারা কিছুটা সময় নিচ্ছে। এক্ষেত্রে ভোটের পর নির্বাচিত এমপিরা শপথ নেওয়ার পরপরই তাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে তফসিল ঘোষণা হবে। অবশ্য আইন অনুযায়ী এক বা একাধিক সংসদীয় আসন শূন্য থাকলেও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আইনগত কোনও বাধা নেই। সর্বশেষ ২০১৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগেও দুটি সংসদীয় আসন শূন্য ছিল।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় গণনা শুরু হয় ওই বছর ২৪ জানুয়ারি। পরদিন ২৫ জানুয়ারিই তফসিল ঘোষণা হয়েছিল। তখন ভোটের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৮ ফেব্রুয়ারি।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার স্পিকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ভোটগ্রহণের দিন সংসদের বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত হবেন। ওই সাক্ষাতে স্পিকারের বিভক্তি নম্বরসহ ভোটার তালিকাও যাচাই করা হতে পারে। জানা গেছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিষয়ে স্পিকারের সাক্ষাতের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন থেকে এখনও কোনও যোগাযোগ করা হয়নি। ফেব্রুয়ারির ৩/৪ তারিখে স্পিকারের সঙ্গে সিইসির সাক্ষাতের সময় চূড়ান্ত হতে পারে। সাক্ষাতের পর ওইদিন বা তার পরদিন হতে পারে তফসিল। এক্ষেত্রে মনোনয়নপত্র দাখিল, যাচাই ও প্রত্যাহারের সময় খুব কম দিয়ে সংক্ষিপ্ত তফসিলে ভোট হতে পারে।
অবশ্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে একক প্রার্থী হওয়ার শতভাগ সম্ভাবনায় নির্বাচন কমিশনকে ভোটে যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষদিনই নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে। কেবল আনুষ্ঠানিকতার জন্যই ভোটের তারিখ নির্ধারণ করা হবে।
জানা গেছে, রবিবার নির্বাচন কমিশনের কমিশন সভা থাকলেও ওই সভার এজেন্ডায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিষয়টি নেই। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি আলোচনায় আসতে পারে বলে ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের উপসচিব আতিয়ার রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আগামী ২৪ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় গণনা শুরু হবে। সেই হিসেবে আমরা ভোটার তালিকা তৈরিসহ প্রাথমিক প্রস্তুতি গ্রহণ করছি। তবে নির্বাচনের তফসিল হবে এই বিষয়ে কোনও নির্দেশনা আমরা পাইনি।
জানা গেছে, সংসদের চলতি অধিবেশনেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এক্ষেত্রে সংসদের কার্যউপদেষ্টা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতি অধিবেশন ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সিদ্ধান্ত থাকলেও এই মেয়াদ বাড়তে পারে। কার্যউপদেষ্টা কমিটির প্রধান ও জাতীয় সংসদের স্পিকার তার ক্ষমতা বলে সংসদ অধিবেশনের মেয়াদ বাড়ানো বা কমানোর এখতিয়ার রাখেন। কার্যউপদেষ্টা কমিটি তাকে এই ক্ষমতা দিয়ে থাকেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিষয়ে তার সঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাক্ষাতের বিষয়ে এখনও কোনও যোগাযোগ করা হয়নি। এখনও সময় আছে। নিশ্চয়ই তারা যোগাযোগ করবেন।
যেভাবে হয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন
দেশের সংবিধানের বিধান অনুযায়ী প্রণীত ১৯৯১ সালের আইন ও বিধিমালার আলোকে দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মেয়াদ পূর্ণ, মৃত্যু কিংবা পদত্যাগ ও অপসারণের কারণে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়ে থাকে। এর আগে প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেও ১৯৯১ সালের ২ জুলাই সংবিধানের ১২তম সংশোধনীতে পরোক্ষ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান করা হয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮ অনুসারে সংসদ-সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
সংবিধান অনুযায়ী ৩৫ বছর তা তারও বেশি বয়সী এবং সংসদ সদস্য নির্বাচনের যোগ্য যেকোনও ব্যক্তিই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন। তবে তার মনোনয়নপত্রে প্রস্তাবক ও সমর্থক হিসেবে সংসদ সদস্য থাকতে হবে। মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করার সময়ও তার সঙ্গে একজন সংসদ সদস্যকে উপস্থিত থাকতে হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ‘নির্বাচনি কর্তা’হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পরিচালনা করেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে হলে স্পিকারের সঙ্গে আলোচনা করে সিডিউল ঘোষণা করেন। নির্বাচনি সিডিউল ঘোষণার আগে কমিশন সংসদ সদস্যদের বিভক্তি সংখ্যা [সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের জন্য বরাদ্দকৃত বিভক্তি সংখ্যা (সংসদীয় আসনক্রম ১-৩৫০ নম্বর)], নাম ও নির্বাচনি এলাকা উল্লেখ করে ভোটার তালিকা প্রস্তুত ও প্রকাশ করবে। এক্ষেত্রে কোনও সংসদীয় আসন শূন্য হলে ওই আসনের অনুকূলে বরাদ্দকৃত বিভক্তি নম্বরটি ভোটার ক্রমিকে বাদ থাকবে।
সংসদ অধিবেশনের সময় এই নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। তবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রয়োজনীয় সময়ে যদি অধিবেশন না থাকে, তাহলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার স্পিকারের সঙ্গে আলোচনা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে ভোটগ্রহণের কমপক্ষে সাতদিন আগে অধিবেশন আহ্বান করবেন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে স্বাভাবিক সময়ের মতো রাষ্ট্রপতিকে অধিবেশন ডাকতে হবে না।
নির্বাচনি কর্তা (নির্বাচন কমিশন) ভোটগ্রহণের দিনের বৈঠকের সভাপতিত্ব করবেন। কমিশন কর্তৃক নিযুক্ত কর্মচারীদের সহায়তায় ভোট গ্রহণ পরিচালনা করবেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য সংসদ-সদস্যদের বৈঠক সংসদ কক্ষে অনুষ্ঠিত হবে। সংসদে স্পিকার সংসদ অধিবেশন চলার সময় শৃঙ্খলার স্বার্থে যে ব্যবস্থা নেবেন, ভোটের দিন নির্বাচনি কর্তা সেই ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকারী হবেন। যেকোনও ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ তাকে সহযোগিতা করতে বাধ্য থাকবে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দিনে নির্বাচন ছাড়া সংসদের অন্য কোনও কার্যক্রম চলতে পারবে না। নির্বাচনে একাধিক প্রার্থী থাকলে নির্বাচনি কর্তা নির্বাচনের দিন দুপুর ১২টার পর সংসদ কক্ষে প্রার্থীদের প্রস্তাবক ও সমর্থকের নাম ঘোষণা করবেন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী, একাধিক প্রার্থী হলে সংসদের অধিবেশন কক্ষে নির্বাচনি কর্মকর্তার সামনে নির্ধারিত ব্যালট পেপারে পছন্দের প্রার্থীর নাম ও নিজের স্বাক্ষর দিয়ে তা জমা দিতে হবে। এর মুড়ি অংশে স্বাক্ষর দিয়ে ভোটারদের ব্যালট পেপার সংগ্রহ করতে হবে। ভোট দেওয়ার পর সংসদ কক্ষে স্থাপিত এক বা একাধিক ব্যালট বাক্সে তা জমা দিতে হবে।
প্রত্যেক সংসদ সদস্যের একটি মাত্র ভোট থাকবে। সংসদ সদস্য হিসেবে স্পিকারও এই নির্বাচনে একজন ভোটার। ভোটের দিন গ্যালারিসহ সংসদ কক্ষে প্রার্থী, ভোটার, ভোট নেওয়ায় সহায়তাকারী কর্মকর্তা ছাড়া সবার প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করবেন নির্বাচনি কর্মকর্তা। ভোট শেষে নির্বাচন কমিশনার প্রকাশ্যে ভোট গণনা করবেন। সর্বাধিক সংখ্যক ভোটপ্রাপ্তকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে। আর সমান ভোট পেলে প্রার্থীদের মধ্যে লটারির মাধ্যমে ফল নির্ধারণ করা হবে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯১ সালে পরোক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান চালু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সাত বার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরমধ্যে মাত্র একবার রাষ্ট্রপতি পদে একাধিক প্রার্থী থাকায় সংসদে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। আর ওই সময়ে বিরোধী দল ও বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থী করেছিল বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীকে। ওই নির্বাচনে আব্দুর রহমান বিশ্বাস বিজয়ী হন। এছাড়া প্রত্যেক বার একক প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে এর কোনও ক্ষেত্রেই সংসদ কক্ষে ভোটগ্রহণের প্রয়োজন পড়েনি।
সংবিধানে যা বলা হয়েছে
সংবিধানের ৪৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, আইন অনুযায়ী সংসদ সদস্য কর্তৃক রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন। কারও বয়স ৩৫ বছরের কম ও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য না হলে কেউ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতে পারবেন না।
রাষ্ট্রপতির মেয়াদ কার্যভার গ্রহণের সময় থেকে পাঁচ বছর। তবে মেয়াদ শেষ হলেও তার পরবর্তী রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্বীয় পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। একাদিক্রমে হোক না না হোক দুই মেয়াদের বেশি কেউ রাষ্ট্রপতি পদে থাকতে পারবেন না।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়সীমা সম্পর্কে সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে। সংবিধানের ১২৩ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি-পদের মেয়াদ অবসানের কারণে ওই পদ শূন্য হইলে মেয়াদ সমাপ্তির তারিখের পূর্ববর্তী ৯০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে শূন্য পদ পূরণের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ ক্ষণগণনা শুরুর ৩০ দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে।’