দেশের মানুষের কাছে নৌকার কোনো বিকল্প নেই : প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, তার দল প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করে যাওয়ায় দেশের মানুষের কাছে নৌকা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, ‘তারা (দেশবাসী) জানে নৌকা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক এবং নৌকা ছাড়া তাদের গতি নাই। কেননা, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে নিজের ভাগ্য গড়ার জন্য নয়, বরং অনেক মানুষের ভাগ্য গড়তে এবং জন্মলগ্ন থেকে সেই আদর্শ নিয়েই রাজনীতি করে যাচ্ছে।’
তিনি সকলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বিষয়ে বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে আরও বলেন, ‘নেতৃত্ব শূন্য কোন দল নির্বাচন করবে আর জনগণ ভোট দেবে কি দেখে। ঐ চোর, ঠকবাজ, এতিমের অর্থ আত্মস্যাৎকারী অথবা খুন, অস্ত্র চোরাকারবারী, সাজাপ্রাপ্ত আসামী তাদেরকে জনগণ ভোট দেবে দেশ পরিচালনার জন্য? তারাতো তা দেবে না। বাংলাদেশের মানুষ এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন।’
প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা আজ সকালে দলের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির ভাষণে এ কথা বলেন।
তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের সাহায্যে দলীয় কার্যালয় ২৩, বঙ্গবন্ধু এভেনিউ এর মূল অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা পদ্মা সেতু করেছি নিজেদের অর্থে অথচ এটা নিয়ে বিএনপি প্রশ্ন তোলে, যাদের আপাদমস্তক দুর্নীতিতে ভরা তারা আবার প্রশ্ন তোলে কোন মুখে? সে প্রশ্নও তিনি উত্থাপন করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওরাতো কিছুই করে যেতে পারেনি। জাতির পিতা তাঁর প্রথম জাপান সফরে যে যমুনা সেতু করার উদ্যোগ নেন সেটা তাঁকে হত্যার পর ক্ষমতায় আসা জিয়াউর রহমান বন্ধ করে দেন। পরে এরশাদ ক্ষমতায় এসে আবার উদ্যোগ নেন সেতুটি করার। কিন্তু খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার পর সেতুর কাজ খুব বেশি এগোতে পারেনি কারণ সবজায়গায় তাদের ছিল কমিশন খাবার অভ্যেস। মায়ের জন্য, দুই ছেলের জন্য, ফালুর জন্য-অমুক-তমুককে ভাগে ভাগে দিতে দিতে সেখানে আর কেউ কাজ করতে পারতো না। ’৯৬ সালে সরকারে এসে আওয়ামী লীগ এই যমুনা সেতুর সঙ্গে রেল লাইন, বিদ্যুত ও গ্যাসের লাইন জুড়ে দিয়ে একে বহুমুখী করেছে।
তাঁর সরকার সে সময় বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শ না শুনে সেখানে যে রেললাইন সংযুক্ত করে পরবর্তীকালে সেটাই সবথেকে লাভজনক প্রতীয়মান হয়। যে কারণে নতুন একটি ডেডিকেটেড রেল সেতু করার জন্য তারা আবারও ফিরে আসে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতায় নেতৃত্ব দানকারি সংগঠন আওয়ামী লীগ এদেশের পল্লী প্রকৃতি এবং মাটি ও মানুষের কল্যাণ যতটা উপলদ্ধি করতে পারে আর কেউ ততটা বুঝবে না। কারণ, তাদের মনে এখনো রয়ে গেছে ‘পেয়ারা পাকিস্তান’। তাছাড়া, জিয়া, খালেদা এমনকি এরশাদ কারো জন্মই বাংলাদেশে নয়। যেমনটি তিনি এবং জাতির পিতা এই মাটিরই সন্তান, বলেন তিনি।
মাটির টানে, নাড়ীর টানেই তাঁরা এদেশের মানুষের ভাগ্য বিনির্মাণে কাজে লেগেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের আদর্শই হচ্ছে জনগণের সেবা করা।
আলোচনা সভায় সভাপতি মন্ডলীর অন্যতম সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী এমপি, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম বক্তৃতা করেন।
আরো বক্তৃতা করেন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ এমপি, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ, কেন্দ্রীয় সদস্য পারভীন জামান কল্পনা, মহানগর উত্তর এবং দক্ষিণের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান ও আবু আহমেদ মান্নাফী।
দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ এমপি গণভবন থেকে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বানভাসী মানুষের পাশে আওয়ামী লীগ যেমন দাঁড়িয়েছে তেমনি প্রশাসন, সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর সদস্যরা সেখানে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রতিনিয়ত তাদের উদ্ধার ও চিকিৎসা প্রদান, খাদ্য প্রদান ও অন্যান্য সহায়তা প্রদানে সেখানে এতটুকু গাফিলতি নেই।
তিনি বলেন, প্রথম দিন থেকেই আমরা এই বানভাসী মানুষের পাশে আছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে সব প্রত্যন্ত অঞ্চলে কেউ যেতে পারছে না সে সব জায়গার খবর পাওয়ার সঙ্গেই তিনি সশ¯্রবাহিনী মারফত হেলিকপ্টারে করে সেখানে সাহায্য পাঠাচ্ছেন, উদ্ধার তৎপরতা চালানো বা খাদ্য পৌঁছানো হয়েছে। অথচ যারা আজ পর্যন্ত বন্যায় বানভাসী মানুষকে এক মুঠো খাবারও দিতে পারেনি, তাদের পাশে দাঁড়ায়নি, ঘরে বসে তারা কেবল মায়া কান্না করছে, এটাই তাদের চরিত্র।
মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৪৯ সালের এই দিনে পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের ঐতিহ্যবাহী রোজ গার্ডেনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তখন এর নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরবর্তী সময়ে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আদর্শের অধিকতর প্রতিফলন ঘটানোর জন্য এর নাম আওয়ামী লীগ করা হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৯৫৫ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়। আর ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দ দুইটি বাদ পড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে। প্রতিষ্ঠার সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে আটক ছিলেন। তাঁকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
সম্প্রতি লন্ডন থেকে একটি ‘ইউটিউব’ চ্যানেলে প্রচারিত তারেক রহমানের বক্তব্যে ‘৭৫ এর পরাজিত শক্তি’ কথাটির উল্লেখ করায় সেটা নিয়ে আলোচনা সভায় বক্তাদের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী নিজেও তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী খালেদা জিয়া যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সঙ্গে জড়িত সেটা বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সমর্থন দিয়ে তাদের ছেলে তারেক রহমান প্রমাণ করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, কারণ এই খুনীদেরকে বিচারের হাত থেকে মুক্ত করেছিল জিয়াউর রহমান এবং ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে খূনীদের দায়মুক্তি দিয়ে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরষ্কৃত করেছিল।
সরকার প্রধান বলেন,আজকে যখন শুনলাম খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান স্লোগান দেয় ‘৭৫’ এর পরাজিত শক্তি’-এর মধ্য দিয়ে সে এটাই প্রমাণ করেছে যে, তার বাবা এবং মা দ’ুজনেই বাংলাদেশে পাকিস্তানের দালাল ছিল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করতে চেয়েছিল। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও ইতিহাস একে একে মুছে ফেলে দিয়েছিল। এমনকি জাতির পিতার নামটা পর্যন্ত মুছে ফেলেছিল। আর পাকিস্তানি সেনাদের পদলেহন করে চলাটাইতো তাদের অভ্যাস। তারা তো স্বাধীনতার চেতনাতেই বিশ্বাস করে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। এটাই মনে করতে হবে এবং এটা মনে করে এদেরকে করুনা করতে হবে। কিন্তু এরা চক্রান্তকারী, ষড়যন্ত্রকারী সেটাও মনে রাখতে হবে।
জিয়াউর রহমানের হাতে সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা-সৈনিক খুন হওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গুম, খুন এটা তো জিয়াউর রহমানই শুরু করেছিল সেই ‘৭৫-এর পর যখন সে রাষ্ট্রপতি হয়। খালেদা জিয়া এসেও তো আমাদের কত নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। এরশাদের আমলেও আমাদের নেতাকর্মী নির্যাতিত হয়েছে।
তারেক রহমানকে দেশে আসতে দেয়া হচ্ছে না বলে কতিপয় বিএনপি নেতার অভিযোগ খন্ডন করে প্রকৃত চিত্র আলোচনা সভায় তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ২০০৭ সালে তারেক তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে মুচলেকা দিয়েছিল যে, সে আর রাজনীতি করবে না। এই শর্তে সে কারাগার থেকে মুক্তি নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমায়। এটা তো বিএনপি নেতাদের ভুলে যাওয়ার কথা না।
‘কাজেই তাকে তো কেউ বিতাড়িত করে নাই। সেচ্ছায় চলে গিয়েছিল। তারপরে আর সে ফিরে আসেনি। একজন রাজনৈতিক নেতার যদি এই সাহস না থাকে ফিরে আসার সে আবার নেতৃত্ব দেয় কীভাবে’, প্রশ্ন তোলেন তিনি।
জিয়াউর রহমানকে নিহত হতে হয়েছিল ও তার লাশও কেউ খুঁজে পায়নি সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সরকার প্রধান বলেন, ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না।’
সরকার প্রধান বলেন, মৃতদেহ সৎকারের নামে একটা বাক্স নিয়ে সংসদ ভবনের বর্তমান জিয়ার কবরের জায়গায় রেখে দেয়া হয়েছে এবং সেখানে গিয়ে ফুল এবং মালাও দেয়া হয়। কিন্তু সেখানে খালেদা জিয়ার স্বামীও নাই আর বিএনপি নেতাও নাই। এটা হলো বাস্তবতা। বাস্তব সত্যটা একদিন না একদিন প্রকাশ হবে।
নিজের জীবনে আসা নানা বাঁধা, ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত সফলভাবে মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়ার কথাও দলের নেতাকর্মীদের সামনে তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু কন্যা।
তিনি বলেন, এতিমের অর্থ আত্মস্যাৎ করে সাজা পেয়েছে খালেদা জিয়া। শুধু এতিমের অর্থ আত্মস্যাতই নয়, নাইকো, গ্যাটকো এ রকম বহু মামলা ঝুলে আছে। খালেদা জিয়াতো কোর্টেই যেতে চাইতো না। প্রত্যেকটি প্রকল্প থেকে তারা দুর্নীতি করে টাকা বানিয়েছে।
দুর্নীতি করেই যদি টাকা না বানাবে তাহলে বিদেশে তারেক রহমান এত বিলাসবহুল জীবন যাপন করে কীভাবে? কত টাকা খরচ করে ব্রিটিশ নাগরিক সেজে সেখানে কোম্পানি খুলেছে এবং ধরা পড়ে যাবার এক বছর পরে সেখানে বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। কারণ, আমরা কথা তুলেছিলাম একজন সাজাপ্রাপ্ত বাংলাদেশীকে ব্রিটেন নাগরিকত্ব দেয় কী করে। কাজেই একই বলে চোরের মার বড় গলা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ নিজের ভাগ্য গড়তে আসেনি, জনগণের ভাগ্য গড়তেই এসেছে এবং আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে যদি বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করা যায়, আজ পর্যন্ত এদেশের মানুষের যতটুকু অর্জন সবটুকুই আওয়ামী লীগের হাতে। আর আওয়ামী লীগ যখনই সরকারে এসেছে এ দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে।
তিনি বলেন, এ জন্য বার বার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে দেয়া হয়নি, যাতে করে দেশের মানুষকে আরো বেশি শোষণ ও নির্যাতন করতে পারে তারা।
২১ বছর পর সরকার গঠন করে ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যা অর্জন করেছিল পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সবই নস্যাৎ করে। খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন দেশকে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত এবং টানা পাঁচ বার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন করে।
সেই অসম্মানজনক জায়গা থেকে দেশের ভাবমূর্তির আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে তাঁর সরকার আজ দেশকে একটি সম্মানজনক অবস্থায় আনতে পেরেছে, বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকের বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল এবং উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে।