সীতাকুন্ডে কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ৩ তদন্ত কমিটি গঠন, নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩৮
চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে একটি কনটেইনার ডিপোতে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় পৃথক ৩টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বিএম ডিপোর ঘটনা তদন্তে টার্মিনাল ম্যানেজারকে প্রধান করে ৩ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। এই কমিটিকে ৩ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায় তিন সদস্যের অপর একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। অধিদপ্তরের সহকারী মহিপরিদর্শক শিপন চৌধুরীকে প্রধান করে গঠিত কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে শ্রম পরিদর্শক (স্বাস্থ্য) শুভংকর দত্তকে। আরেক সদস্য হলেন শ্রম পরিদর্শক (নিরাপত্তা) মো. শামীম হোসেন। কমিটিকে আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে সরেজমিনে পরিদর্শনপূর্বক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। এ দিকে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগেও একটি তদন্ত কমিটি গঠন হয়।
এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের ৭ কর্মীসহ এ পর্যন্ত ৩৮ জন নিহত হয়েছে। আহত ও দগ্ধ হয়েছে আরো চার শতাধিক। আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আগুনের উৎস সম্পর্কে বলতে না পারলেও ফায়ার সার্ভিসের ধারণা, শনিবার রাত সাড়ে ১০ টার দিকে সীতাকুন্ডস্থ বিএম কন্টেইনার ডিপোতে একটি কেমিক্যাল-ভর্তি কন্টেইনার থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এরপরই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। আগুন লাগার সাড়ে ১৪ ঘণ্টা পার হলেও এখনো সেটি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট। ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর আড়াইশ সদস্য কন্টেইনার ডিপোটিতে অগ্নিনির্বাপনে তাদের মিশন শুরু করেছেন।
স্থানীয়রা জানান, আগুন লাগার অল্পক্ষণ পরই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে বিএম ডিপো এলাকার চারপাশে পাঁচ কিলোমিটার প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, প্রায় ২৬ একর আয়তনের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে এখনো আগুন জ¦লছে। ফায়ার সার্ভিসের ২৫ টি ইউনিট সেখানে কাজ করছে। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক জানিয়েছেন, কন্টেইনারে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড থাকার কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।
সীতাকুন্ডে কন্টেইনার বিস্ফোরণের পরপরই আহতদের আর্তনাদে এলাকায় বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। প্রথমে স্থানীয়রা এবং কুমিরা ফায়ার সার্ভিস অগ্নিনির্বাপনের চেষ্টা চালায়। অবস্থা বেসামাল দেখে চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা থেকেও ফায়ার সার্ভিস ইউনিটকে সীতাকু-ে নিয়ে আসা হয়। রাত একটার দিকে ফায়ার সার্ভিসের পানি সংকট সৃষ্টি হয়। পরে বিভিন্নভাবে পানি যোগাড় করে তারা আবার আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। রাত সাড়ে তিনটার দিকে একের পর এক কন্টেইনার বিস্ফোরণ শুরু হলে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা নিরাপদ স্থানে সরে যান। ভোর থেকে তারা আবার বিভিন্ন কন্টেইনার ও কন্টেইনারবাহী লরিতে লাগা আগুন নির্বাপনে কাজ শুরু করেন।
অন্যদিকে, বিস্ফোরণের পর আহতদের বিভিন্ন গাড়িতে করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো শুরু হয়। ঘটনার ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে এর পরপরই চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াস চৌধুরী চমেক হাসপাতালে উপস্থিত হন। আহতদের সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে তিনি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত সকল স্তরের চিকিৎসকদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসার আহবান জানান। সিভিল সার্জনের আহবানে সরকারি-বেসরকারি সকল এম্বুলেন্স সীতাকু-ে গিয়ে আহতদের পরিবহনে লেগে পড়ে।
বিভিন্ন টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়লে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, গাউছিয়া কমিটিসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কয়েক হাজার মানুষ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভিড় জমান। সময়ের সাথে সাথে আহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী মধ্যরাতেই চমেক হাসপাতালে ছুটে যান। তিনি সাংবাদিকদের জানান, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সকল পর্যায়ের ডাক্তারসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসার জন্য তিনি নির্দেশ দিয়েছেন।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানিয়েছে, আগুন লাগার পর তাদের দু’টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছালে তাদেরকে কন্টেইনারে রাসায়নিক পদার্থ থাকার কথা জানানো হয়নি। তাদের বলা হয়েছিল, ওই কন্টেইনারে গার্মেন্টস পণ্য রয়েছে। এ কারণেই তারা আগুন নেভাতে পানি ছিটিয়েছিলেন। দাহ্য পদার্থের বিষয়ে অবগত হলে তারা পানির পরিবর্তে ফোম ব্যবহার করতেন। এতে বিস্ফোরণ ঘটতো না এবং ক্রমান্বয়ে এতগুলো কন্টেইনারে আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়তে পারতো না।
চমেক হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, আহত ও নিহতদের স্বজনদের আর্তনাদে মেডিকেলের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠেছে। অনেকে নিখোঁজ স্বজনের জন্য চমেক হাসপাতালে বিভিন্ন ওয়ার্ডে যাচ্ছেন। ফায়ার সার্ভিসেরই ৭/৮ জন কর্মী এখানো নিখোঁজ রয়েছেন। ফায়ার সার্ভিসের ৩০ কর্মী ও পুলিশের ১০ সদস্য আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। চিকিৎসাধীন চার শতাধিকের মধ্যে অনেকেরই অবস্থা গুরুতর। তাদের রক্ত দেয়ার জন্য স্বেচ্ছাসেবীরা চমেক ব্লাড ব্যাংকে অপেক্ষমাণ রয়েছেন।