সরকার বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে : প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁর সরকার চলমান কোভিড-১৯ মহামারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাতের পটভূমিতে বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা আজ জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থ বছরের বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে এ কথা বলেন। তিনি এ সময় কৃচ্ছতা সাধন এবং সঞ্চয়ে মনযোগী হওয়ার জন্য সকলের প্রতি আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘চলমান করোনা অতিমারির অভিঘাত এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বৈশি^ক সরবরাহ শৃংখল ব্যাহত হওয়ায় আমদানী ভিত্তিক মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের বর্তমান মূল্যস্ফীতির যে উর্ধ্বগতি তা নিয়ন্ত্রণে রাখার ওপর প্রাধান্য দিয়েই এই বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘অতিমারী আমাদের অর্থনীতিতে বিরাট ক্ষতি সাধন করেছে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি এই অতিমারীর ক্ষতি সামলে সমৃদ্ধ উন্নয়নের পথে ফিরে আসার। আর সেক্ষেত্রেও আমরা সাফল্য অর্জন করে বড় একটি বাজেটও দিতে পেরেছি। আমরা ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার একটি বাজেট উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছি যা অনেক দেশই পারেনি। কাজেই আমি মনে করি আওয়ামী লীগ সরকারের এটি বিরাট সাফল্য।’
শেখ হাসিনা বলেন, শত বাধা ও চাপের মুখে পড়লেও আমরা দৃঢ়ভাবে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। অনেক প্রতিকুল অবস্থায় আমাদের এগুতে হচ্ছে। যেখানে উন্নত দেশগুলো হিমসিম খাচ্ছে সেখানে আমরা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিশীলতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি। এ ব্যাপারে সকলের সহযোগিতা কামনা করি।
তিনি বলেন, দেশে-বিদেশে সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করেই আমরা অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করছি। তার মূলেই রয়েছে এদেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, যাদের একটা আলাদা শক্তি রয়েছে। শুধু যদি একবার তারা অনুধাবন করতে পারে তাহলেই সেই শক্তিটা বোঝা যায়, যেটা পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রেও হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার ডাকে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে একদা এদেশের মানুষই বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। তাঁরা জীবন বিলিয়ে দিয়েছিল। আর সেই মানুষের দেশ আমাদের বাংলাদেশ। কাজেই সেই মানুষকে নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। বিশ^ব্যাপী করোনাভাইরাস এবং যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই আমরা এগিয়ে যাব ইনশাল্লাহ।
তিনি বলেন, ২০২২-২৩ অর্থ বছরের জন্য যে বাজেট জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়েছে আমি মনে করি জনগণের সর্বাত্মক সহযোগিতায় আমরা তা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবো, ইনশাল্লাহ।
কৃচ্ছতা সাধনের ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন আমাদের প্রধান কাজ হচ্ছে প্রত্যেককেই নিজ নিজ জায়গা থেকে যতটুকু সম্ভব কৃচ্ছতা সাধন করতে হবে, সঞ্চয় করতে হবে। প্রত্যেকের নিজস্ব সঞ্চয় বাড়ানোর পাশাপাশি সকলকে মিতব্যয়ী হতে হবে। বিলাস দ্রব্য পরিহার করে শুধু প্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনাতেই মনযোগী হতে হবে।
তাঁর সরকার আজকে ঘরে ঘরে যে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে সেটি ব্যবহারে এবং পানি সহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধাগুলো ব্যবহারেও তিনি সকলকে মিতব্যয়ী হবার আহবান জানান ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান বৈশি^ক প্রেক্ষাপটে তাঁর সরকারকে সার, বিদ্যুৎ, তেল ও গ্যাসের ক্ষেত্রে বর্ধিত ভর্তুকি প্রদান করতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে আগামী অর্থ বছরে জ¦ালানি তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, সার ও বিদ্যুৎ খাতে যে ঘাটতি হবে তা আমরা মূল্য বাড়িয়ে ভোক্তা সাধারণের ওপর শতভাগ চাপিয়ে দেব না। যার ফলে আগামী অর্থবছরে ভতুর্কির ব্যয় বাড়বে সে কারণে কার্যকর ভর্তুকি ব্যবস্থানার মাধ্যমে ভর্তুতিকে সহনশীল পর্যায়ে রাখা এবং আমদানীর ওপর চাপ কমানোর লক্ষ্যে আমরা যথাযথ পদক্ষেপ নেব।
তাঁর সরকার মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার জন্য সবধরণের পদক্ষেপ নিয়েছে বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মূদ্রাস্ফীতি যাতে নিয়ন্ত্রণে থাকে তার ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের জন্য টাকার মূল্যমান পুননির্ধারণ করা হচ্ছে। এটা একটি চলমান প্রক্রিয়া।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় সকলকে দেশী পণ্য ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে বলেন, সকলকে দেশী পণ্য ব্যবহারের দিকে নজর দিতে হবে। তিনি এ প্রসঙ্গে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নের উল্লেখ করে কথায় কথায় চিকিৎসার জন্য বিদেশে ছুটে যাওয়াকেও নিরুৎসাহিত করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, কোভিড-১৯ এর আরেকটি ঢেউ এসেছে। চতুর্থ ঢেউ। করোনা ভাইরাস আমরা সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করেছি। পাওয়ার যোগ্য সবাইকে টিকা দিয়েছি। জীবন জীবিকার সুরক্ষা যতটুকু দেওয়ার তার সবটুকুই আমরা দিতে সক্ষম হয়েছি। করোনা নতুনভাবে আবার দেখা দিয়েছে। সবাইকে বলবো স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে চলতে। করোনা মোকাবিলায় আমরা যে সাফল্য এনেছি সেটা ধরে রাখতে হবে।
তিনি বলেন, তাঁর সরকার করোনা মোকাবিলার প্রণোদনা হিসেবে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের জন্য ২৮টি প্যাকেজের আওতায় ১ লাখ ৮৭ হাজার ৬শ ৬৯ কোটি টাকার সহায়তা প্রদান করেছে।
করোনাভাইরাস ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অতিমারি আমাদের অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে। তবে, আমরা এই ক্ষতি সামলে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। সরকার কার্যকর ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। যে কোনো ধরনের বাধা আসুক না কেন আমরা তা মোকাবিলা করতে পারবো। সেই বিশ্বাস আমাদের রয়েছে। করোনা অতিমারির সময়ে সরকারে যে প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে তা চলমান থাকবে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের রপ্তানি বেড়েছে। আমরা ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি রপ্তানি করতে পেরেছি। অতিমারি মোকাবিলা করেও ৫০ বিলিয়নের ক্লাবে প্রবেশ করতে পেরেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বাজেটে কৃষি খাতের বিকাশ অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে কৃষি যন্ত্রপাতি, ছত্রাক ও বালাই নাশক উৎপাদন উপকরণ আমদানীর ক্ষেত্রে আগাম কর যৌক্তিকিকরণ করা হয়েছে। এছাড়া পশু পাখি, মৎস খাতের চলমান বিকাশ অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে নিবন্ধিত পোল্টি, ডেইরী ও ফিস ফিড সরবরাহের যন্ত্রাংশ আমদানীর ক্ষেত্রে মুসক অব্যাহতি প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি কৃষি ও খাদ্য শিল্পে ব্যবহার্য যন্ত্রপাতিতে রেয়াতি সুবিধা সম্প্রসারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
তিনি বলেন, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি এবং দ্রুততম সময়ে করদাতা সেবা নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে অটোমেটেড ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সব প্রস্তুতি গ্রহণ, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা এবং স্থানীয় শিল্পের বিকাশে ও বাণিজ্য সহজীকরনের মাধ্যমে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং রপ্তানীমুখী ও ভারি শিল্পের বিকাশের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান এবং ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ এই শ্লোগান অব্যাহত রাখা সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য, সার, বীজ, জীবন রক্ষাকারি ওষুধ এবং আরো কতিপয় শিল্পের কাঁচামালের ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুল্ক হার অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্য খাতকে সুসংহতকরণে ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানীতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। একইসাথে শ্রবণ প্রতিবন্ধী ও শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের ব্যবহার্য কতিপয় পণ্যের ওপর প্রযোজ্য শুল্ক হ্রাস করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
তিনি বলেন, শিল্প খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে এবং রপ্তানী শিল্পের প্রসারের কৌশল হিসেবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, রপ্তানীমুখী শিল্প, ইস্পাতজাত শিল্প, মোটরসাইকেল উৎপাদন শিল্প, রাবার শিল্প, ইলেকট্রনিক্স শিল্পের উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানীতে রেয়াতি সুবিধা প্রধান ও তৈরী পণ্য আমদানীতে শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশীয় কম্পিউটার বা ল্যাপটপ বা আইসিটি পণ্যের কাঁচামাল আমদানীতে রেয়াতি সুবিধা সম্প্রসারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়, আমদানী নিরুৎসাহিতকরণ এবং বিলাস পণ্য নিয়ন্ত্রনের লক্ষ্যে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন বিলাসবহুল মোটর গাড়ি ও জিপ এবং ঝাড় বাতি ও লাইট ফিটিংসের ওপর আমদানী পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক আরোপের মাধ্যমে কর বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বাংলাদেশ ক্ষতবিক্ষত উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়েই আমাদের চলতে হয়। দুর্যোগ মোকাবিলায় জাতির পিতা দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের দেশে এখন বন্যা চলছে। দক্ষিণাঞ্চলে ভাদ্র মাসের দিকে আসে। এই বন্যাও আমরা মোকাবিলা করতে পারবো। পদ্মা সেতু এই বন্যা মোকাবিলায় সহায়তা করবে।
সবার জন্য পেনশন বিমা চালুর বিষয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এ প্রক্রিয়ায় অনেক দূর এগিয়েছি। অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরে সর্বজনীন পেনশন চালুর ঘোষণা দিয়েছেন। মন্ত্রীসভার সর্বশেষ বৈঠকে এ আইনের অনুমোদন দিয়েছি। খুব শিগগির সংসদে আইনটি উঠবে। আমরা তা কার্যকর করতে পারবো। তাতে যারা পেনশন পাবেন, তাদের জীবনটা সুরক্ষিত হবে।