শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর ‘বঙ্গবন্ধু’ উচ্চারণ সহজ হয়
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর এই দেশ থেকে তার নাম-ধাম মুছে ফেলতে তৎপর হয় ঘাতকরা। সে সময় যারা প্রতিবাদ সংগঠিত করতে সচেষ্ট ছিলেন, তারা বলছেন, মোশতাকের সামরিক শাসনে শিথিলতা থাকলেও ১৯৭৫-এর নভেম্বরে জিয়ার শাসন কঠিন ছিল। আর পুরোটা সময়েই বঙ্গবন্ধুর নাম প্রকাশ্যে যেন না আসে, সেই চেষ্টা ছিল ঘাতক ও তাদের সহচরদের। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা দীর্ঘ প্রবাস জীবন শেষে দেশে ফিরে আসার পর পত্রপত্রিকাগুলোতে তার বরাত দিয়ে ফিরে আসে বঙ্গবন্ধুর নাম।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরের দিন থেকে পত্রিকার পাতায় নেতাদের বয়ানে ছিল না বঙ্গবন্ধুর কোনও কথা। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে শেখ হাসিনা দেশের মাটিতে ফিরে আসার সুযোগ পান। সেদিন তার আসার খবর দেশের জাতীয় দৈনিকে এক কলামে (সিঙ্গেল কলাম) দায়সারাভাবে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে খবর দেখতে পায় দেশের মানুষ। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সভাপতি শেখ হাসিনা ১৯ মে দুপুর দেড়টায় লঞ্চে করে টুঙ্গিপাড়া পৌঁছান। ১০৩ ডিগ্রি জ্বরে অসুস্থ অবস্থায় প্রথমে তিনি তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি জিয়ারত করেন। জিয়ারত শেষে মোনাজাতের সময় একপর্যায়ে তিনি ‘খোদা আপনি খুনিদের বিচার করুন’, এ কথা উচ্চারণ করে অজ্ঞান হয়ে যান।
পরে সেখানে এক জনসমাবেশে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনারা (জনগণ) ছাড়া দুনিয়াতে আমার কেউ নেই। আমার জন্য দোয়া করুন, যেন আপনাদের ভালোবাসা অর্জন করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে পারি।’ সমাবেশে দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের আপসহীন সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য দলীয় কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান।
সেই সময়ে যারা সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় ছিলেন তারা বলছেন, ‘বঙ্গবন্ধু’ ‘জাতির জনক’ ‘জয় বাংলা’ এসব উচ্চারিত হোক, তা কোনোভাবেই চায়নি ঘাতক ও ষড়যন্ত্রকারীরা। প্রতি রাতে কারফিউ বলবৎ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আর্মি-পুলিশ নিয়মিত টহল দিতো। কলাভবনের অদূরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও শাহবাগের মোড়ের কাছে বেতারকেন্দ্রে ছিল ট্যাংক-মেশিনগান সজ্জিত খুনি চক্রের সদস্যরা।
সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার বলেন, ‘এরশাদের শাসনামলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কিছু কথা বলা যেতো। ততদিনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরতে পেরেছেন। তার বরাত দিয়েও পত্রিকাগুলো কিছু কথা লিখতে পারতো। কিন্তু জিয়াউর রহমানের শাসনামলে একেবারেই উচ্চারিত হতে শোনা যায়নি। গণমাধ্যম পরবর্তী সময়ে নানা কৌশলে কিছু মানুষের লেখা প্রকাশ করেছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশে ফিরে আসাটা সেসব ক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছিল।’
এর আগে বঙ্গবন্ধুর নাম যেন উচ্চারিত না হয়, সেজন্য ঘাতকেরা ক্ষমতা দখল করে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে দেশ-বিদেশে কুৎসা-অপপ্রচার চালিয়ে আসছিল উল্লেখ করে তৎকালীন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন হিসেবে গঠিত জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অজয় দাশগুপ্ত বলেন, ‘বারবার সবাইকে জানানো হচ্ছিল হত্যাকাণ্ডের কোনও প্রতিবাদ কেউ করেনি। কিন্তু ৪ নভেম্বরের মিছিল থেকে দেশবাসী বার্তা পায়—বাংলাদেশের জনগণের মনে বঙ্গবন্ধু আছেন, থাকবেন। আমরা সেটা করেছিলাম। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার সময় আমরা নিশ্চিত হই যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্বাধীনতা সংগ্রামের চার মহান নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে ২ নভেম্বর গভীর রাতে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়েছে। সে ঘটনায় আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের মনোবল অনেকটা ভেঙে যায়। এ সুযোগেই জিয়াউর রহমান ৭ নভেম্বর পাল্টা অভ্যুত্থান সংঘটিত করতে পারেন।’