বিশ্বের কোন দেশ বিদ্যুৎ ও গ্যাসে ভর্তুকি দেয়, প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রীর
বিশ্বের কোন দেশ বিদ্যুৎ ও গ্যাসে ভর্তুকি দেয় সেই প্রশ্ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমরা তো বিদ্যুতে ভর্তুকি দিচ্ছি। গ্যাসে ভর্তুকি দিচ্ছি। আমার প্রশ্ন হলো পৃথিবীর কোন দেশ গ্যাস আর বিদ্যুতে ভর্তুকি দেয়? কেউ দেয় না।
ব্যবসায়ী ও শিল্পকারখানার মালিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ চাইলে যে মূল্যে কিনে আনবো সেই মূল্য তাদের দিতে হবে। সেই মূল্যই তাদের দিতে হবে। এখানে ভর্তুকি দেওয়ার কোনও যৌক্তিকতা নেই।
বুধবার (১৮ জানুয়ারি) জাতীয় সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় সংসদ নেতা এসব কথা বলেন। এর আগে জাতীয় পার্টির মহাসচিব পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে আইএমএফ-এর ঋণের শর্তে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ সরকার কীভাবে সামলাবে সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি।
আইএমএফ তখনই ঋণ দেয় যখন ওই দেশ ঋণ পরিশোধের যোগ্যতা অর্জন করে উল্লেখ করে চুন্নুর বক্তব্যের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানে আমরা তেমন কোনও শর্ত দিয়ে ঋণ নেইনি।
তিনি বলেন, আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়েছি। বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়িয়েছি। কিন্তু বিদ্যুৎ ব্যবহারে সবাইকে সাশ্রয়ী হতে হবে। ইংল্যান্ডে বিদ্যুতের দাম ১৫০ ভাগ বাড়িয়েছে এই ইউক্রেন আর রাশিয়ার যুদ্ধের পর। আমরা তো মাত্র ৫ শতাংশ আজ বাড়ালাম। আর বাড়ছে বাল্কের কিছু গ্যাসের দাম। এলএনজি আমরা যেটা ৬ ডলারে স্পট প্রাইসে কিনতাম, সেটা এখন ৬৮ ডলারে। কত ভর্তুকি দেবে সরকার? সরকার যে ভর্তুকিটা দেবে সেটা তো জনগণেরই টাকা। আর দ্রব্যমূল্য আজ সারা বিশ্বেই বৃদ্ধি পেয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, আমরা নিম্ন আয়-মধ্যম আয়ের যারা তাদের জন্য টিসিবির ফেয়ার প্রাইস কার্ড দিয়ে দিয়েছি। যেখানে ৩০ টাকা কেজিতে চাল কিনতে পারে। তেল, চিনি, ডাল সীমিত আয়ের মানুষ ন্যায্য মূল্যে কিনতে পারে। সেই ব্যবস্থাটা করে দিয়েছি। এর থেকে যারা নিম্ন আয়ের তাদের জন্য আমরা ১৫ টাকায় চাল আমরা দিচ্ছি। সেই সঙ্গে তেল, ডাল ও চিনিও দেওয়া হচ্ছে। আর একেবারে হতদরিদ্র যারা কিছুই করতে পারে না, তাদের বিনা পয়সায় খাদ্য সরবরাহ করছি। স্বল্প আয়ের মানুষ যাতে কষ্টে না পড়ে সেদিকে দৃষ্টি রেখে এই ব্যবস্থা করছি। কৃষিতে আমরা ব্যাপকভাবে ভর্তুকি দিচ্ছি।
তিনি বলেন, ইংল্যান্ডের মতো জায়গায় ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ হচ্ছে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি। এটা একটা উন্নত দেশের কথা বললাম। পৃথিবীর সব দেশে এই অবস্থা বিরাজমান। বাংলাদেশ এখনও সেই অবস্থায় পড়েনি।
ভর্তুকি প্রশ্নে তিনি বলেন, গ্যাস উৎপাদন ও বিতরণ; বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণে যদি ৪০, ৫০ ও ৬০ হাজার কোটি টাকা আমাকে ভর্তুকি দিতে হয় তাহলে সেটা কী করে দেবো? এর ফলে দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার যে চেষ্টা সেটা করে কিছুটা সফলতা দেখাতে পেরেছি। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে।
সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম যদি বৃদ্ধি পায় তাহলে মানুষ যদি একটু সাশ্রয়ী হয়..। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও গণভবনে বিদ্যুতের ব্যবহার ৫০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছি। এভাবে যদি সবাই উদ্যোগ নেয়, তাহলে বিদ্যুৎ ব্যবহার সাশ্রয়ী হতে পারে।
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, যারা বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ী আছেন, এখানেও (সংসদে) আছে, তাদের আমি তো স্পষ্ট বলেছি। গ্যাস আমি দিতে পারবো। কিন্তু যে মূল্যে গ্যাস আমরা বাইরে থেকে কিনে নিয়ে আসলাম সেই মূল্য যদি আপনারা দেন আমরা গ্যাস দিতে পারবো। আমরা বাল্কের যেটুকু বাড়ানোর বাড়িয়েছি। তারা যদি নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ চায় তাহলে যে মূল্যে কিনে আনবো সেই মূল্য তাদের দিতে হবে। সেই মূল্যই তাদের দিতে হবে। এখানে ভর্তুকি দেওয়ার কোনও যৌক্তিকতা নেই।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, এটা ভুলে যাবেন না ভর্তুকির টাকা তো জনগণেরই টাকা। যত মূল্য কম থাকে তাতে আমাদের বিত্তশালীরা লাভবান হন। যারা সাধারণ মানুষ তারা ঠিকমতো বিল দেয়। বিত্তশালীরা আরাম-আয়েশ করবে, আর স্বল্প মূল্যে পাবে তা কী করে হয়? সেদিকে লক্ষ রেখেই আমরা আমাদের পরিকল্পনা নিচ্ছি।
এর আগে জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে বলেন, আইএমএফের ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ দেশে আলোচিত। এই ঋণ পেতে কয়েকটি শর্ত পূরণ করতে হচ্ছে। এই ঋণের কারণে ইতোমধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। ঋণের কারণে গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে। এতে কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে যাবে। সামগ্রিকভাবে উৎপন্ন পণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়বে। এই চাপ সরকার কীভাবে মোকাবিলা করবে?
মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র বাংলাদেশ সফরের প্রসঙ্গ টেনে চুন্নু বলেন, মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু পাকিস্তান সফরের পর তেহরিক-ই ইনসাফ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে যায়। তিনি বাংলাদেশে আসার পরে অনেকে মনে করেছিলেন সরকারের কিছু একটা হবে। জানি না উনি যাওয়ার পরে সরকারকে মনে হয় খুব খুশি খুশি লাগছে। আবার একটি দল মনে হয় খুবই অখুশি। আমরা জাতীয় পার্টি এটাকে ওইভাবে নিচ্ছি না। এটাকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছি। রাজনৈতিকভাবে বর্তমান যে অবস্থাটা, মানুষের মাঝে একটি গুঞ্জন আছে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার কারণে কিছু একটা কী যেন হয়। এ ধরনের কিছু আছে কিনা? বিষয়টি পরিষ্কার গভর্নমেন্টের কাছ থেকে… এ সময়ে মাইক বন্ধ হয়ে যায়। তিনি মাইক ছাড়াও আরও কিছু বলতে থাকেন। একপর্যায়ে মাইক চালু হলে বলতে শোনা যায়—জাতি জানবে। সবার জন্য ভালো হবে। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য তার বক্তব্যের এই অংশের জবাব দেননি।
প্রসঙ্গত: সর্দি জ্বরে আক্রান্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার সংসদে এম আব্দুল লতিফের মৌখিক প্রশ্নের দীর্ঘ ১৭ পৃষ্ঠার জবাব দেন। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে উত্তর দিতে গিয়ে তিনি কিছুটা অসুস্থবোধ করেন। একপর্যায়ে তিনি ‘আমার অস্থির লাগছে’ উল্লেখ করে বসে উত্তর দেওয়ার জন্য স্পিকারের কাছে অনুরোধ করেন। তবে তিনি বসে তার বক্তব্যের বাকি অংশ পঠিত বলে গণ্য করার অনুরোধ করেন।
পরে আব্দুল লতিফ একটি সম্পূরক প্রশ্ন করলে প্রধানমন্ত্রী দাঁড়িয়ে তার সংক্ষিপ্ত জবাব দেন। এ সময় স্পিকারের সংসদ নেতাকে উদ্দেশ করে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি বসেও বলতে পারেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী, এটা বলে শেষ করে দেবো। ওই সময় তিনি ৩০ সেকেন্ডের মতো কথা বলেন। পরে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর শেষ হয়।
প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তরের পর জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ মনোযোগ আকর্ষণের নোটিশের কার্যক্রম স্থগিত করে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনার আগে চুন্নুকে পয়েন্ট অব অর্ডারে বক্তব্য দেওয়ার জন্য ফ্লোর দেন।
চুন্নু পয়েন্ট অব অর্ডারে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বক্তব্য দিয়ে তার জবাব চান। পরে প্রধানমন্ত্রী আবারও ফ্লোর নিয়ে বলেন, একটু সর্দি-কাশি হয়েছে বলে বেশি বলতে চাচ্ছিলাম না। আর ছাড়তেও চাই না। শুধু প্রশ্নের উত্তর দিতে এসেছিলাম। এই প্রশ্নের উত্তরটা না দিলেই নয়।