বিশ্বমানের চলচ্চিত্র তৈরি করুন : চলচ্চিত্র শিল্পী, পরিচালক ও প্রযুক্তিবিদদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সিনেমা যাতে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি অর্জন করতে পারে সেজন্য যথাযথ প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে বৈশ্বিক মান বজায় রেখে মানসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন ।
তিনি বলেন, ‘চলচ্চিত্র শিল্পী, পরিচালক এবং প্রযুক্তিবিদদের উন্নত প্রশিক্ষণ নিয়ে আরও মানসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাণ করা উচিত যাতে আমাদের সিনেমা বিশ্ব মানের সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-২০২২’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
জাতির পিতার ছোট কন্যা এবং প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশ্বমানের চলচ্চিত্র যাতে নির্মাণ হয় সেই পদক্ষেপ আপনারা নেবেন, সেটাই আমি চাই। এ সময় তাঁর সরকার বিশ্বমানের আধুনিক এফডিসি কমপ্লেক্স নির্মাণ করে দিচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, আমরা চাই, আমাদের চলচ্চিত্র দেশের অঙ্গন ছাড়িয়ে বিদেশেও সমাদৃত হোক। তিনি এই বিষয়টিতেও নজর দেওয়ার জন্য চলচ্চিত্র শিল্পী, কলা-কুশলী সকলের প্রতি আহ্বান জানান। কেননা মানুষের জীবনে যেহেতু স্বচ্ছলতা এসেছে এবং তারা বিনোদনের দিকেও ঝুঁকছে কাজেই তাদের জন্য বিনোদনের ক্ষেত্রটাও আপনারা তৈরী করে দিতে পারেন।
তিনি বলেন, আমাদের যারা চলচ্চিত্র অঙ্গনের ভাইবোনেরা এখানে আছেন, বিভিন্ন চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন তাদেরকে আমি বলবো আপনারা একটু নজর দিলে সমাজের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে যে ভাল ভাল চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যায় ইতোমধ্যেই আপনারা প্রমাণ করেছেন। ইদানিং কালে নির্মিত অনেক চলচ্চিত্রই মান সম্পন্ন এবং পারিবারিক বিনোদন ধর্মী বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশনে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন-২০২৩’ তাঁর সরকার পাশ করে দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা মনে করি যে আইনের বলে চলচ্চিত্র শিল্পে মাননির্নয়ের ব্যবস্থাও সন্নিবেশিত হবে। আমরা চাই না যে আমাদের দেশে অশ্লিল চলচ্চিত্র বা পাইরেসি চলুক।
তিনি বলেন, আমাদের সকলেরই যে মেধা আছে সেই মেধা কাজে লাগিয়ে ভাল চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যায়। সে ব্যবস্থাটা যাতে হয় সেটাই আমরা চাই।
এ সময় ফিল্ম আর্কাইভ ভবন এবং ১৬ তলা আধুনিক তথ্য ভবন নির্মাণসহ সরকারের চলচ্চিত্র ও গণমাধ্যম উন্নয়নের বিভিন্ন পদক্ষেপও তুলে ধরেন এবং প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি বলেন, সরকার যে ট্রেনিং ইনস্টিটিউট করে দিয়েছে সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া যেতে পারে। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা বিষয়টিতে যাতে মন দেন।
তিনি শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ বৃদ্ধি করার ওপর গুরুত্বারোপ করে এজন্য তাঁর সরকার প্রয়োজনীয় সকল সহযোগিতা দেবে বলে জানান।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বিজয়ী শিল্পী ও কলাকুশলীদের হাতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২২ তুলে দেন।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু। স্বাগত বক্তব্য রাখেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. হুমায়ুন কবির খন্দকার। আজীবন সম্মাননা প্রাপ্ত শিল্পি রোজিনা অনুষ্ঠানে নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করেন।
এরআগে গত ৩১ অক্টোবর তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় ২৭টি ক্যাটাগরিতে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-২০২২’ এর বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের স্বাধীনতা অনেক ত্যাগের ফসল। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে এই অর্জন। আমাদের অনেক শিল্পী কলা-কুশলীরাও তখন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।
তিনি বলেন, একটি দেশের সমাজকে চলচ্চিত্র অনেক বেশি সচেতন করতে পারে। আনন্দ দিতে পারে আবার সংস্কারও করতে পারে। ইতিহাসকে ধরে রাখতে পারে। প্রেরণা দিতে পারে মানুষকে। জাতি গঠনে ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
তাঁর সরকার ২০১২ সালের ৩ এপ্রিল এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে চলচ্চিত্র নির্মাণ, বিতরণ ও প্রদর্শনসহ সংশ্লিষ্ট সকল কাজকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা দেয়, যাতে, এটা শিল্প হিসেবেই গড়ে ওঠে এবং অন্যান্য শিল্প যে সুযোগ-সুবিধা পায় এটিও সেগুলো পেতে পারে। আর জাতীয় শিল্প নীতির আওতায় চলচ্চিত্র শিল্প ইতোমধ্যেই বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। সরকার সময়ের সাথে তাল মেলাতে ‘চলচ্চিত্র সংসদ নিবন্ধন আইন-২০১১’ এবং ‘জাতীয় চলচ্চিত্র নীতিমালা-২০১৭’, এবং ‘যৌথ প্রযোজনা চলচ্চিত্র নীতিমালা-২০১৭’-ও প্রণয়ন করেছে।
একদা গ্রাম বাংলায় একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত সিনেমা শিল্প প্রদর্শনের হলগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি হল মালিকদের সঙ্গে এনিয়ে বৈঠক করে সিনেমা হলের উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন উল্লেখ করে বলেন, সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতায় ১ হাজার কোটি টাকার তহবিলও গঠন করে দিয়েছে। জেলা পর্যায়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে আধুনিক তথ্য কমপ্লেক্স নির্মাণেরও পদক্ষেপ ও গ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, সিনেমা শিল্প যেন মানুষের কাছে পৌঁছতে পারে এবং মানুষ যাতে বিনোদনের সুযোগ পায় সেজন্য তাঁর সরকারের এই পদক্ষেপ কেননা দেশের মানুষের আয় বেড়েছে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে। কাজেই এই বিনোদনের ক্ষেত্রটাও যেন আরো প্রসারিত হয় সেদিকেই তাঁর সরকার বিশেষ দৃষ্টি দিচ্ছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই এদেশে চলচ্চিত্র শিল্পের গোড়াপত্তন ১৯৫৬ সালে যখন তিনি মন্ত্রী ছিলেন তখন। সেকথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পূর্ব পাকিস্তান ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (ইপিএফডিসি) বিল, যা বঙ্গবন্ধু ১৯৫৭ সালের ২৭ মার্চ অস্থায়ী আইনসভায় উত্থাপন করেছিলেন এবং একই বছরের ৩ এপ্রিল পাস হয়েছিল।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছর ধরে দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে জাতির পিতার জীবন ও কর্মের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ ও ভারত যৌথভাবে নির্মিত মুজিব বায়োপিক ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ নির্মাণে সহযোগিতার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে তিনি ধন্যবাদ জানান। ছবিটি সারাদেশে এবং ভারতে বাংলা ও হিন্দি উভয় ভাষায় মুক্তি পেয়েছে এবং ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে।
শেখ হাসিনা এর নির্মাতা বিখ্যাত ভারতীয় পরিচালক শ্যাম বেনেগালসহ সিনেমায় সংশ্লিষ্ট অভিনয় শিল্পি-কলা কুশলীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। তিনি আশা করেন এই চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন হিসেবে বিবেচিত হবে। কেননা জাতির পিতার জীবনী মানেই বাংলাদেশের ইতিহাস। কেউ বাঁশির ফুঁ দিল আর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল এমনটা হয়নি। এর পেছনে রয়েছে ২৩ বছরের সংগ্রামের ইতিহাস।
তিনি এ সময় এই বায়োপিকসহ জাতির পিতার জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে এবং পরবর্তী সময়ে জাতির পিতাকে নিয়ে নির্মিত বিভিন্ন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, প্রামাণ্য চিত্র এবং এনিমেশেন ফিল্ম বা শিল্পকর্মের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা পরে দর্শক সারিতে বসে চলচ্চিত্র শিল্পীদের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।