নতুন বাজেট অর্থনীতি আরও গতিশীল করবে : অর্থমন্ত্রী
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি আরও গতিশীল হবে। এই বাজেট প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যতা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। বাজেটে দারিদ্র্য দূরীকরনে দরিদ্র শ্রেণীর ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত এই বাজেট প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, ব্যবসায়ি এবং স্বল্প আয়ের লোকসহ সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য সহায়ক হবে। আমরা এমন ভাবেই এই বাজেট প্রণয়ন করেছি।
অর্থমন্ত্রী বলেন, বিগত তিন মেয়াদকালে তার দায়িত্বপালনকালে জনগণ প্রতারিত হয়নি। জনগনের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি তিনি রক্ষা করেছেন তিনি আরও বলেন, আমরা প্রতিটি মানুষ এবং প্রত্যেক দরিদ্র মানুষের কথা বিচেনায় রেখে এই বাজেট প্রণয়ন করেছি।
অর্থমন্ত্রী আজ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, অর্থবিভাগের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার, এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সেলিম উল্লাহ, পরিকল্পনা বিভাগের সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী এবং ইআরডি সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন প্রমুখ।
এ ছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিবগণ এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করেন। এতে প্রবৃদ্ধি ধরা হয় ৭.৫ শতাংশ এবং গড় মূল্যস্ফীতি ৫.৬ শতাংশ।
অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা তুলে ধরে উন্নয়নমুখী চিন্তাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ‘আগামী বাজেট কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাবে কারণ অনেক উত্থান-পতন হবে। আমরা সব বাধা অতিক্রম করে সফল হতে পারব, ইনশাআল্লাহ। আমরা দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই।’
কামাল উল্লেখ করেন যে, কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাবে যখন সমগ্র বিশ্ব ক্ষতিগ্রস্ত, তখন বাংলাদেশের কোনো ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি এবং সামষ্টিক অর্থনীতির সব সূচক ভালো ছিল।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি মোকাবেলায় সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন যে, সরকার চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে যাতে কোনও অমিল না ঘটে সে লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
তিনি বলেন, যদিও সামগ্রিক বাজেটের আকার বিদায়ী অর্থবছরের তুলনায় জিডিপির শতাংশে হ্রাস পেয়েছে, সরকার সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি থেকে সংকোচনমূলক মুদ্রনীতিতে তার ফোকাস সরায়নি।
অর্থমন্ত্রী দাবি করেন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের দাম এখন কম হলেও আমদানি পণ্যের দাম নির্ভর করে বিশ্ববাজারের দামের ওঠানামার ওপর।
তিনি বলেন, ‘তবে, আমি আশা করি, বাজারে অস্থিতিশীলতা বেশি দিন থাকবে না। সরকারের অবশ্যই কিছু প্রচেষ্টা থাকবে এবং সরকার এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সরকার এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হবে না। আমরা ‘সবাইকে সাথে নিয়ে এটি মোকাবেলা করতে সক্ষম হব’।
কর প্রদানের মাধ্যমে কিছু বাংলাদেশীকে বিদেশে তাদের অপ্রদর্শিত সম্পদ বৈধ করার জন্য সাধারণ ক্ষমা দেওয়ার উদ্যোগ সফল হবে কিনা জানতে চাইলে কামাল বলেন, সরকার এটাকে ‘কালো টাকা’ না বলে ‘অপ্রকাশিত অর্থ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। ‘আমরা সেই অপ্রকাশিত টাকা ফেরত আনার চেষ্টা করছি।’
তিনি বলেন, কর ক্ষমা কোন নতুন ধারণা নয় এবং ইন্দোনেশিয়া ২০১৬ সালে এই ধরনের সুযোগ দিয়ে বিদেশ থেকে প্রায় ৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ফিরিয়ে এনেছিল।
তিনি বলেন, ‘এই ধরনের সুবিধা দিতে গিয়ে আমরা কোনো প্রশ্ন তুলব না এবং কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না। অনেক সময় সিস্টেমের কারণে অর্থ ও সম্পদ অপ্রকাশিত থেকে যায়।’
এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী জানান, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, নরওয়ে, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের প্রায় ১৭টি দেশ এ ধরনের সাধারণ ক্ষমা দিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘মাঝে মাঝে গরমিল হয়, আমি কখনো বলিনি যে, টাকা পাচার হয় না। বরং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে এবং তাদের অনেকেই ইতিমধ্যেই জেলে গেছে… আমরা পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার চেষ্টা করছি।’
তিনি আশা প্রকাশ করেন, সংশ্লিষ্ট সকলেই আগামী বাজেটে এ ধরনের সুযোগ কাজে লাগাবেন এবং এভাবে তাদের অর্থ ও সম্পদ বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলধারায় ফেরত পাঠাবেন।
তিনি বলেন, ‘আমার বিশ্বাস তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না। কিন্তু যারা হুন্ডির সাথে জড়িত তারা সবসময় ভয়ের মধ্যে থাকবে। একমাত্র উপায় হলো সরকারি নিয়ম-কানুন মেনে চলা।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে কামাল বলেন, তিনি এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক এমডি পিকে হালদারকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আশাবাদী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) মানি লন্ডারিং, সন্দেহজনক লেনদেন এবং নগদ লেনদেনের প্রতিবেদন তদন্তের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং এটি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে, সরকার আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশীদের কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন না হয়ে দেশের বাইরে তাদের অপ্রকাশিত সম্পদ বৈধ করার সুযোগ দিয়েছে। এই সুযোগ পেতে হলে তাদের মাত্র ৭ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতে হবে। নতুন অর্থবছরের প্রথম দিন থেকে এই সুযোগ কার্যকর হবে এবং আগামী বছরের ৩০ জুন শেষ হবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো রহমাতুল মুনীম বলেন, এ ধরনের সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশীরা ট্যাক্স রিটার্নে তাদের সম্পদ দেখাতে ও হালনাগাদ করতে পারবেন।
এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, যেহেতু আওয়ামী লীগ সরকার একটি সাংবিধানিক সরকার এবং এটি আইনের শাসন মেনে চলে, তাই এই সাধারণ ক্ষমা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হবে।
কামাল বলেন, খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক চাহিদা বিবেচনায় সাধারণ মানুষের অগ্রাধিকার দিয়ে এই বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। এছাড়াও, সার্বজনীন পেনশন প্রকল্প চালু করা হবে এবং করের হার কমানো হয়েছে যাতে আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতা মোকাবেলায় সরকারের কাছে কোনো ‘যাদুকরী হাতিয়ার’ আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সরকার মহামারী শুরু থেকে আগের অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করছে।
মূল্যস্ফীতি সাধারণত দেশের অভ্যন্তরে এবং ‘আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি’ থেকে তৈরি হয় উল্লেখ করে কামাল বলেন, আপাত হাতিয়ার হলো দেশের মানুষ সহিষ্ণু এবং এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় যথেষ্ট সহনশীল।
অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ধারণাকে সামনে রেখে দেশীয় কোম্পানিগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জগুলো একা আসে না, বরং সেগুলোও আসে অপার সুযোগ নিয়ে।
আমি এই সুযোগে বিশ্বাস করি। আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি, যাতে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত না হয়। তিনি বলেন, বিগত অর্থবছরে রপ্তানি আয় ৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে সুযোগগুলো উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে, যা বিশ্বের কোনও দেশই অর্জন করতে পারেনি।
কামাল বলেন, নগদ প্রণোদনার কারণে অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্স প্রবাহও ১৪ বিলিয়ন ডলার থেকে ২৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। আমরা যদি রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ৪০ শতাংশে উন্নীত করতে পারি, তবে আমি মনে করি কোন চ্যালেঞ্জ থাকবে না।
তিনি উল্লেখ করেন যে, আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ১২ বছরের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মোট ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছিল, ২০০৯ সালে এটি ছিল মাত্র ৭ বিলিয়ন ডলার। রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ না হলে এটি ৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারত। ইনশাআল্লাহ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবার ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।
এক প্রশ্নের জবাবে অর্থসচিব রউফ বলেন, সর্বজনীন পেনশন স্কিমের খসড়া আইন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে এবং মন্ত্রিসভা থেকে অনুমোদন পেলে খসড়া আইনটি কার্যকর করার জন্য সংসদে যাবে।
রউফ বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারের ব্যাংক ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা বেসরকারি খাতে ঋণের পরিমান বৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনা তৈরি করবে না, বরং ব্যাংকগুলো তাদের অলস অর্থ বিনিয়োগ করতে পারবে।
৮২,৭৪৫ কোটি টাকার উচ্চ ভর্তুকি বরাদ্দ সরকারের জন্য কোনো উদ্বেগের কারণ হবে কিনা জানতে চাইলে কামাল বলেন, উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
এর প্রতিউত্তরে অর্থসচিব বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস, সয়াবিন তেল, ইউরিয়া সারের দাম বাড়লেও সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি অব্যাহত রেখেছে। তিনি আরও বলেন, বিশ্ববাজারে দাম কমলে তেমন কোনো সমস্যা থাকবে না। কিন্তু, বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে চ্যালেঞ্জ হবে।
রউফ বলেন, সরকার গত বছর মহামারী চলাকালীন দরিদ্র লোকদের জন্য প্রায় ৪.৫০ লাখ মেট্রিক টন চাল সরবরাহ করেছিল, পরবর্তী বাজেটে খাদ্য ভর্তুকি বাড়বে।
তিনি আরও জানান, সরবরাহের দিক বজায় রাখতে আগামী অর্থবছরে কৃষি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি বাড়ানো হবে। এছাড়া আগামী অর্থবছরের প্রথম দিন থেকেই কিছু কঠোরতামূলক ব্যবস্থা দৃশ্যমান হবে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি।
এনবিআর চেয়ারম্যান মুনিম বলেন, সরকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা সাধারণত প্রতি বছর বাড়ে। সরকার আগামী বছর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছে যাবে।