অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে নির্মিত হবে দেশের প্রথম পাতালরেল
আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হতে যাচ্ছে ৩১ দশমিক ২৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২১টি স্টেশন নিয়ে এমআরটি লাইন ওয়ান প্রকল্পের কাজ। প্রকল্পে থাকছে দুটি অংশ—একটি উড়াল ও অন্যটি পাতাল। পাতালের অংশটি বিমানবন্দর থেকে শুরু হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত আসবে। আরেকটি অংশ যাবে নতুন শহর পূর্বাচলে। এটি নতুন বাজার থেকে শুরু হয়ে পিতলগঞ্জ ডিপো পর্যন্ত গেলেও মানুষ যাতায়াত করবে পূর্বাচল টার্মিনাল স্টেশন পর্যন্ত। এর জন্য পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ের সএঙ্গ পূর্ণাঙ্গ সমন্বয় থাকবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘনবসতিপূর্ণ এই রাজধানীতে পাতালরেলের কাজ করতে গিয়ে এখানকার কোথাও কোনও স্থাপনা ভাঙতে হবে না। আগে থেকেই এসব বিষয় সমন্বয় করা হয়েছে। ফলে কাজটি ঠিকঠাকভাবেই সম্পন্ন হবে বলে মনে করছেন তারা।
বৃহস্পতিবার (২ ফেব্রুয়ারি) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের চার নম্বর সেক্টরে জনতা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে দেশের প্রথম পাতাল মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করবেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দুটি ভাগে হবে। প্রথম ভাগে প্রধানমন্ত্রী প্রথম পাতাল মেট্রোরেলের উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করবেন। অনুষ্ঠানে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ উপস্থিত থাকবেন বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। অনুষ্ঠান শুরু হবে সকাল ১১টায়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বেশি লম্বা হবে না। দ্বিতীয় ভাগে অনুষ্ঠিত হবে সুধী সমাবেশ। সেখানে মন্ত্রিসভার সদস্যসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা থাকবেন। সমাবেশে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পে অর্থের অপচয় যেন না হয়—এ বিষয়টি মাথায় রেখেই কাজ করা হবে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ হবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৫৬১ দশমিক ৪৩ কোটি টাকা। সরকারিভাবে ১৩ হাজার ১১ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। এছাড়া প্রকল্প সহায়তা হিসেবে জাইকা দেবে ৩৯ হাজার ৪৫০ দশমিক ৩২ কোটি টাকা। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট লাইন ওয়ানের বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে কাজ করছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড-ডিএমটিসিএল।
এমআরটি লাইন ওয়ান প্রকল্পে ১২টি প্যাকেজ রয়েছে। ডিপোর উন্নয়ন কাজ দিয়ে শুরু হয়েছে প্রকল্পের কাজ। পিতলগঞ্জ ও ব্রাহ্মণখালি মৌজায় ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হওয়ায় এখন প্রকল্প নির্মাণ কাজের দিকে গড়াচ্ছে। এজন্য ৯২ দশমিক ৯৭২৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। এ কাজে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ২১৯ দশমিক ১০৭৮ কোটি টাকা। ডিপো নির্মাণের জন্য ১ হাজার ৩৩ জন ভূমি মালিক, ১২ জন ব্যবসায়ী ও দুটি সাধারণের ব্যবহার্য প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের পুনর্বাসনের জন্য ৩৬ কোটি ৯৪ লাখ ৩২৮৪ টাকা ক্ষতিপূরণের সংস্থান রাখা হয়েছে। পুনর্বাসন কার্যক্রম এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। কাজটি করার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে নিয়োগ করা হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে ভূমি উন্নয়নের কাজ করা হবে। এ কাজে অ্যাডভান্স টেকনোলজি ব্যবহার করা হবে। কাজটি সুপারভিশন করার জন্য এরইমধ্যে কনসালটেন্ট নিয়োগ করা হয়েছে।
প্রকল্পে আরও ১১টি প্যাকেজ রয়েছে। এসব প্যাকেজের টেন্ডার প্রক্রিয়াকরণ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। টেকনিক্যাল ইভালিউশন ও ফিনান্সিয়াল ইভালিউশন শেষ হলে পর্যায়ক্রমে কার্যাদেশ দেওয়া হবে। কার্যাদেশ দেওয়ার পর শুরু হবে মোবিলাইজেশন।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এআরটি সিক্স মেট্রোরেলের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এমআরটি লাইন ওয়ানের কাজ করা হবে। একই সাথে বিভিন্ন জায়গা থেকে কাজ শুরু হবে। রুট অ্যালাইনমেন্ট ধরে বিভিন্ন জায়গা থেকে একই সময়ে কাজ শুরু হবে।
অধিকাংশ অংশ পাতালে নির্মাণ হবে বলে একসাথে কাজগুলো করতে সমস্যা হবে না। সবগুলো প্যাকেজের কাজ প্রায় একই সঙ্গে শুরু করা হবে। একসঙ্গে কাজ শুরু করলে ঢাকা মহানগরের বাসিন্দারা কী ধরনের সমস্যায় পড়তে পারেন—এমন প্রশ্নে কর্মকর্তারা বলেন, এ কাজে টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) ব্যবহার করা হবে। এটি খুবই সফিস্টিকেটেড একটি মেশিন। মাটির দশ মিটার (প্রায় ৩২ ফুট) নিচ দিয়ে টানেলটি তৈরি করা হবে। একই সাথে তৈরি করা হবে প্রিকাস্ট সেগমেন্টগুলোও। অর্থাৎ মাটিও কাটা হতে থাকবে, রেলের টানেলও প্রস্তুত হতে থাকবে।
কিন্তু যেসব সড়কের প্রশস্ততা কম—বিশেষ করে রাজারবাগ এবং মালিবাগের মধ্যবর্তী একটি এলাকা—সেখানে একটা টানেলের উপর আরেকটা তৈরি হবে। এ জায়গায় মাটির একটু বেশি নিচে যেতে হবে। নিচের টানেলটা প্রায় ৭০ মিটার নিচে থাকবে। বাদবাকি অংশে ৩০ মিটার নিচে দিয়ে পাশাপাশি টানেল নির্মাণ করা হবে।
দুটি টানেল দিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে চলাচল করবে পাতাল মেট্রোরেল। সাড়ে তিন মিনিট পরপর রেল চালানোর জন্য সিস্টেমটি ডেভেলপ করা হয়েছে। এ সময়টি আরও কমিয়ে আনতে কাজ করা হচ্ছে। এমআরটি লাইন সিক্স মেট্রোরেল ছয়টি কোচ দিয়ে চালানোর চিন্তা করে করা। সেটিতে আরও দুটি কোচ সংযোজনের সুযোগ রাখা হয়েছে। কিন্তু এমআরটি লাইন ওয়ানে প্রথমেই আটটি কোচ দিয়ে শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে। আন্তর্জাতিক মান মেনেই আটটি কোচ দিয়ে শুরু করা হবে এটি।
এমআরটি লাইন সিক্সের প্লাটফর্ম হয়েছে রাস্তার উপরের অংশে, আর এমআরটি লাইন ওয়ানের স্টেশন হবে মাটির নিচে। এমআরটি লাইন ছয় যেমন তিনতলা মাটির উপরে হয়েছে ঠিক সেভাবেই এমআরটি লাইন ওয়ান হবে তিনতলা মাটির নিচে। জনসাধারণের ভোগান্তি যেন কম হয় সেটি মাথায় রেখেই অত্যাধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। পাতালরেলের জন্য রাস্তায় অর্ধেক অংশে মাটি খনন করা হবে। যন্ত্রপাতি মাটির নিচে নিয়ে যেতে এটি করা হবে। সব যন্ত্রপাতি মাটির নিচে নিয়ে খনন করা অংশটির উপরিভাগ পুরো স্টিলের পাত দিয়ে ঢেকে দেওয়া হবে। ঢেকে দেওয়া অংশের উপর দিয়ে ৪০ মেট্রিকটন ওজনের গাড়িও চলাচল করতে পারবে। গাড়ি চলাচলের জন্য অংশটি যখন খুলে দেওয়া হবে তখন দ্বিতীয় অংশে একইভাবে খননের কাজ করা হবে। সেটি শেষ হলে উপরিভাগ একইভাবে ঢেকে দেওয়া হবে। যতদিন স্টেশন নির্মাণ কাজ শেষ না হবে ততদিন এভাবে চলবে।
রাস্তার উপরিভাগের কাজ করতে ছয় মাসের মতো সময় লাগবে। নিচে যে কাজ চলবে উপর থেকে সেটি বোঝা যাবে না। তাছাড়া টিবিএম মেশিন দিয়ে টানেল কাটার সময়ও উপর থেকে নিচে চলা নির্মাণযজ্ঞ সম্পর্কে বোঝার কোনও উপায় থাকবে না। টানেল যখন হবে তখন রাস্তার নিচে ইউটিলিটি শিফটিংয়ের কোনও প্রয়োজন হবে না। কারণ ঢাকা মহানগরীতে ১০ মিটারের নিচে দিয়ে কোনও ইউটিলিটি লাইন টানা নেই।
টানেল নির্মাণকাজের সময় মাটির নিচে আলো-বাতাস-পানির যাতায়াতের বিষয়টি অ্যাড্রেস করা হয়েছে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি নিষ্কাশন করতে সেন্সর ব্যবহার করা হবে। অতিরিক্ত পানি এলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিষ্কাশন মেশিন চালু হয়ে যাবে।
পাতালরেল প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এমএএন ছিদ্দিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিশ্বের জনবহুল শহরের একটি ঢাকা। এখানে পাতালরেল ছাড়া ভালো বিকল্প দেখছি না। যেখানে শহর ডেভেলপ হয়ে গেছে সেখানে আমরা পাতালে যাবো। আর যেখানে শহর নতুন করে গড়ে উঠছে, সেখানে এলিভেটেড করছি। হেমায়েতপুর থেকে ঢাকার ভিতরে ঢোকার মুখ পর্যন্ত আমরা এলিভেটেড করছি। এটা সারা বিশ্বের বাস্তবতা।’
বিমানবন্দর রুট
দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৮৭২ কিলোমিটার। মোট পাতাল স্টেশনের সংখ্যা ১২টি। স্টেশনগুলো হচ্ছে—বিমানবন্দর, বিমানবন্দর টার্মিনাল, খিলক্ষেত, নদ্দা, নতুন বাজার, উত্তর বাড্ডা, বাড্ডা, আফতাবনগর, রামপুরা, মালিবাগ, রাজারবাগ, কমলাপুর।
পূর্বাচল রুট
১১.৩৬৯ কিলোমিটারে মোট স্টেশন থাকবে ৯টি। স্টেশনগুলো হচ্ছে—নতুন বাজার, নদ্দা, জোয়ার সাহারা, বোয়ালিয়া, মস্তুল, শেখ হাসিনা ক্রিকেট স্টেডিয়াম, পূর্বাচল সেন্টার, পূর্বাচল পূর্ব, পূর্বাচল টার্মিনাল। পূর্বাচল সড়কের মধ্যে ৩.৬৫৭ কিলোমিটার ট্রানজেকশন অংশ রয়েছে। ৯টি স্টেশনের মধ্যে সাতটি স্টেশন হবে উড়াল।