বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই : প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতি কোটা বিরোধী আন্দোলনের ছদ্মবেশে জঙ্গিবাদের বর্বরতা প্রত্যক্ষ করেছে। তিনি বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের কোনো স্থান নেই বলে তাঁর অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের কোনো স্থান হবেনা। তাদের প্রধান শক্তি জামায়াতে ইসলাম ও শিবিরকে সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯-এর ১৮ ধারায় নিষিদ্ধ করা হবে।’
প্রধানমন্ত্রী আবারও জাতিসংঘ (ইউএন) এবং অন্যান্য দেশের কাছে তাদের দক্ষতার মাধ্যমে দেশব্যাপী তা-ব চলাকালীন প্রতিটি ঘটনার তদন্তে অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করার জন্য সহযোগিতা চেয়েছেন।
আজ রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ-এ স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি ও আলোচনা ও দোয়া মাহফিলে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসকে সামনে রেখে বাংলাদেশ কৃষক লীগ (বিকেএল) এই কর্মসূচির আয়োজন করে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে সতর্ক করেছেন, জামায়াত ও শিবির আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে এবং নিষিদ্ধ হওয়ার পর তাদের ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালিয়ে যাবে।
তিনি বলেন, ‘সবাইকে এ লক্ষ্যে সতর্ক থাকতে হবে এবং আমি দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি জানেন তার জীবন নাশের প্রচেষ্টা আগের ঘটনার মতো বারবার আসতে পারে।
তিনি বলেন, ‘কিন্তু, আমি পাত্তা দিই না। আল্লাহ জীবন দিয়েছেন এবং তিনি তা নিয়েও নেবেন। জনগণের কল্যাণে যা যা করা দরকার আমি সবই করব।’
সাম্প্রতিক সহিংসতায় বহু মানুষের প্রাণহানি ও সরকারি সম্পত্তি ধ্বংসের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোটা আন্দোলনের আড়ালে জঙ্গিরা তাদের হিংস্র দাঁত দেখিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সর্বস্ব হারিয়ে কাছের এবং প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা তিনি জানেন।
তিনি বলেন, ‘সুতরাং, আমি প্রত্যেকটি জিনিসের (হত্যাযজ্ঞের) তদন্ত চাই যে, এর পিছনে কারা রয়েছে এবং কীভাবে এবং কী কী ঘটনা ঘটেছে।’
তিনি আরও বলেন, তাঁর সরকার সাম্প্রতিক সহিংসতায় ছয়জনের মৃত্যুর তদন্তের জন্য এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করেছে।
পরে কমিশন গঠনের পর বিপুল সংখ্যক ঘটনা সংঘটিত হওয়ায় এর পরিধি সম্প্রসারণ করে তিনজন সদস্য করা হয়।
শেখ হাসিনা প্রতিটি বিষয়ে তদন্তের জন্য জাতিসংঘকে তাদের বিশেষজ্ঞ পাঠানোর আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘যদি কোনো দেশ চায়, তারা বিশেষজ্ঞও পাঠাতে পারে। আমি বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্ত চাই। যারা এর জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের নির্মিত সম্পত্তি ধ্বংস করে দেশবাসীর ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা তারা আর সহ্য করবেন না।
তিনি আরও বলেন, বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য দেশব্যাপী তা-ব চালানো হয়েছে।
অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ফরিদুর নাহার লাইলী প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
বাংলাদেশ কৃষক লীগের সভাপতি সমীর চন্দের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক উম্মে কুলসুম স্মৃতি।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
অনুষ্ঠান শেষে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের শহীদ ও সাম্প্রতিক সহিংসতায় নিহতদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনায় মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্দোলন ধ্বংসস্তুপে রূপ নেওয়ার আগে পুলিশসহ আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী এদের সঙ্গে সহনশীল আচরণ করেছে। তারা মিছিল করে যেখানে যেতে চেয়েছে, তাদের সেখানে যেতে দিয়েছে। তিনি নিজেও আইনশৃংখলা বাহিনীকে তাদের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য বলেছেন।
তিনি আমেরিকায় সম্প্রতি গাজায় ইসরাইলের আগ্রসনের প্রতিবাদরত শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের ওপর সরকারি সংস্থার হামলার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, আমেরিকায় যেভাবে মেরে ধরে, শিক্ষকদের রাস্তার ওপর ফেলে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে হার্ড লাইনে গিয়ে আন্দোলন দমন করেছিল, তাঁর সরকার সে পথে যায়নি এবং শক্তিও প্রয়োগ করেনি। বরং তাদের দাবি মেনে নিয়েছে। আসলে তাদের দাবিটা কি? সরকারি চাকরীতে কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন হাইকোর্টে পক্ষভুক্তদের আবেদনের প্রেক্ষিতে বাতিল হওয়ায় সরকার আপিল বিভাগে আবেদন করেছে। আপিল বিভাগ শুনানির দিন ধার্য করে হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেছে অর্থাৎ কোটা বাতিলই ছিল। পরবর্তীতে আপিল বিভাগের রায়ও ছাত্রদের চাহিদার চাইতে বেশিই এসেছে। আর এটাতো তাঁরই দাবি ছিল, সেখানে আন্দোলনের আর কি থাকে! সেখানে আজকে যে ঘটনাগুলো ঘটলো।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশব্যাপী মিথ্যা অপপ্রচার সমানে চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি ক্ষমতায় থেকে মানুষের জীবন নেব, সেটা তো কখনো হতে পারে না। আমি তো নিজেই সবকিছু হারিয়েছি এবং গ্রেনেড হামলা, বোমা হামলা ও সরাসরি গুলি করে বারবার আমাকে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছে এবং আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়েছেন। তারপরেও আমি সাহস নিয়ে কাজ করে গেছি। ভয়ও পাইনি, পিছুও হটিনি। কারণ আমার লক্ষ্য এ দেশের মানুষের জীবন-মান উন্নয়ন- সে কাজটা আমাকে করতে হবে।
শেখ হাসিনা আরো বলেন, “আমি বলতাম ‘টাইম ইজ টু শর্ট’। কেননা যে কোন জায়গায়, যে কোন সময়ে ঘাতক আমাকে আঘাত করতে পারে। কিন্তু যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আঁশ, আমি মানুষের জন্য কাজ করবো।
তিনি বলেন, লক্ষ্য স্থির করেছিলাম যে- ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটা জায়গায় নিয়ে আসবো, আমরা বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা এনে দিয়েছি। ’৭৫ এ জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশের যে মর্যাদা ভুলুন্ঠিত হয়েছিল, তাকে আবার ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলাম। বিশ্বে বাংলাদেশকে সম্মানের চোখে দেখা হচ্ছিল। আজকে আমরা কি দেখি, সব জায়গায় বাংলাদেশ সম্পর্কে আবার একটা নেতিবাচক মনভাব সৃষ্টি হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, বিশে^ বাংলাদেশের যে ভাবমূর্তি সেটা মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে বিভিন্ন জঙ্গিবাদী ঘটনা ঘটিয়ে আজকে সেই মান সম্মান সব নষ্ট করা হচ্ছে। এটার বিচার আমি জনগণের কাছেই দিচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, এমনভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ পোড়ানো হল- ঠিক ফিলিস্তীনের গাজায় যেভাবে হাসপাতালে বোমা হামলা করে ধ্বংস করা, শিশু হত্যা ও মানুষ হত্যা সেই একই ঘটনা যেন এখানে ঘটানো হচ্ছে। এটাই হচ্ছে সব থেকে দুর্ভাগ্যের।
তিনি বলেন, একটা কোটা আন্দোলনের নাম দিয়ে এই ভাবে একটা নাশকতা ও জঙ্গিবাদী কর্মকান্ড পরিচালনা করা ! যে জন্য তিনি ১৭ তারিখ টেলিভিশন ভাষণে সবাইকে সতর্ক করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি শিক্ষক ও অভিাবকদের বলেছিলাম যে, আপনাদের সন্তানদের জীবনের ঝুঁকি রয়েছে, আপনারা সন্তানদেরকে বের হতে দিয়েন না। কারণ আমিতো জানি এদেশে জঙ্গিবাদী বা সন্ত্রাসি গোষ্ঠী কতদূর কি করতে পারে। আমি তাদেরকে সতর্ক করেছি যে, আপিল বিভাগের রায়ে শিক্ষার্থীদের হতাশ হতে হবে না। তাদের যেটা দাবি সেটা এসে যাবে। কারণ আদালত ও আইন মেনেই সকলকে চলতে হয়।
তিনি বলেন, তারপরেও আজকে বাংলাদেশে এতগুলো প্রাণ যে ঝড়ে গেল এর দায় দায়িত্ব কার? একটা জিনিষ গেলে আবার গড়ে তোলা যায়, কিন্তু জীবন গেলে তো আর ফিরে পাওয়া যায় না।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে বলেন, যারা আপনজন হারিয়েছেন, যে মা তার সন্তান হারিয়েছেন, যে সন্তান তার বাবা হারিয়েছেন তাদের কি কষ্ট সেটা আর কেউ না বুঝুক, আমি তো বুঝি। স্বজন হারাবার বেদনা নিয়ে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করে এদেশে ফিরে এসেছিলাম যেন দেশের মানুষ দারিদ্রের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে একটা সুন্দর ও উন্নত জীবন পায়, স্বাধীনতার সুফল পায়- সে আশায়।
তিনি বলেন, গ্রামগঞ্জসহ প্রতিটি জনপদ ও মানুষের জীবন উন্নত করে দেওয়াটাই কি তাঁর অপরাধ? আজকে নানাভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের বদনাম। আমি জানি, আমি আত্মবিশ^াস নিয়ে, সততা নিয়ে কাজ করে দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করেছি। আমি এদেশের কৃষক ও শ্রমিকসহ প্রতিটি মেহনতী মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করেছি।
যখন থেকে তিনি সরকারে এসেছেন, তখন থেকেই নানারকম ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালে আন্দোলনের নামে বিএনপি -জামায়াতের আগুন সন্ত্রাস, পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করা, গাছ কাটাসহ রাষ্ট্রীয সম্পদ ধ্বংস, ২০০১ পরবর্তী হাজার হাজার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী হত্যা ও নির্যাতন, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ, বাংলা ভাই সৃষ্টি, একই দিনে ৬৩ জেলার ৫শ’ স্থানে একযোগে বোমা হামলা, জজের ওপর হামলা ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর পরবর্তী আন্দোলনের নামে হত্যা, সন্ত্রাস, জ্বালাও-পোড়াও, পিটিয়ে পুলিশ হত্যা আর এবার মানুষকে গুলি, হত্যার পর লাশ ঝুলিয়ে রাখা। মানুষ যেখান থেকে সেবা পায় সেগুলো ধ্বংস করা এবং কিছু কিছু হত্যাকান্ড এমনভাবে ঘটানো হয়েছে- যা এক সময় বের হবে।
এ জন্যই তিনি আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। ঘটনার তদন্তে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করে দিয়েছেন, কারো দাবির অপেক্ষায় রাখেন নি বলে জানান।
যখন ৬ জন মারা গিয়েছিল, তখন তিনি ঘটনার তদন্তে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন করে দেন। এখন আরো ঘটনা ঘটার প্রেক্ষিতে তিন সদস্য বিশিষ্ট বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে তাদের কর্মপরিধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি চাই প্রত্যেকটি জিনিষের তদন্ত হোক। কারণ এর পেছনে কি কি ভাবে কি কি ঘটনা ঘটেছে, তা তদন্তে বেরিয়ে আসুক। আমি জাতিসংঘের কাছেও আবেদন করেছি, তারা যেন তাদের বিশেষজ্ঞ পাঠায়, অন্য কোন দেশ যদি চায় তারাও যেন বিশেষজ্ঞ পাঠায়। কারণ আমি চাই এই ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত হোক।
তিনি আরো বলেন, “যেই দায়ী থাক, আমাদের তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে ।”
তিনি বলেন, আমরা গড়বো আর তারা সব ধ্বংস করে, লন্ডভন্ড করে দেবে, আমার দেশের মানুষকে কষ্ট দেবে, মানুষ ভুক্তভোগী হবে, দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে খেলা- এটাই তো আমি দেখি তাদের সব থেকে বড় জিনিষ।
তিনি বলেন, জঙ্গিরা সারা বিশ্বব্যাপী কি ঘটনা ঘটিয়েছে। বাংলাদেশে হলি আর্টিজেনের পরে আমরা আর একটা ঘটনা ঘটতে দেইনি। আমাদের গোয়েন্দা ও আইনশৃংখলা রক্ষকারী সংস্থাগুলো সজাগ থেকেছে। নিজেদের জীবন দিয়েছেন, কিন্তু এই জঙ্গিবাদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করেছেন। কিন্তু আজকে কোটা আন্দোলনের ছত্রচ্ছায়ায় এরা জঙ্গিদের সেই ভয়াল দাঁত দেখাল।